জাহাঙ্গীরে পাল্টে যেতে পারে ভোটের হিসাব

মসিউর রহমান খান, ইজাজ আহ্‌মেদ মিলন ও আবু সালেহ মুসা, গাজীপুর থেকে

0
137
আজমত উল্লা খান

নৌকার প্রার্থী হয়েও বুক ধুকপুক কমছে না গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানের। তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাতে কাগজে-কলমে ভোটের মাঠে নেমেই পড়েছেন গাজীপুরের আলোচিত চরিত্র জাহাঙ্গীর আলম। এরই মধ্যে তিনি সংগ্রহ করেছেন মনোনয়নপত্র। নাটকীয় কিছু না ঘটলে আজ শেষ দিনে তিনি মনোনয়নপত্র জমাও দেবেন।

গাজীপুর সিটির আগের দুই নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে হয়েছিল আওয়ামী লীগের ভোটের লড়াই। এবার বিএনপি মাঠে নেই, করেছে ভোট বর্জন। তবে প্রার্থী হচ্ছেন আগের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকারের ভাতিজা সরকার শাহ্‌ নুর ইসলাম (রনি সরকার)। গাজীপুরের স্থানীয় রাজনীতিতে এই পরিবারের রয়েছে ভালো পরিচিতি। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সাবেক স্বাস্থ্য সচিব এমএম নিয়াজ উদ্দিন গতকাল বুধবার মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, জাহাঙ্গীর আলম প্রার্থী হলেও শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে টিকে থাকতে পারবেন কিনা– সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের পর শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা করা হয়েছিল। আপাতত মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে তিনি দলের সঙ্গে দরকষাকষির জায়গা তৈরি করতে চাইছেন বলেও মন্তব্য করছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীর আলম ভোটের মাঠে কোনো ফাঁকফোকর রাখছেন না। সে কারণে একসঙ্গে দুটি মনোনয়নপত্র কিনে সবাইকে ভড়কে দিয়েছেন। একটি নিজের, আরেকটি তাঁর মা জায়েদা খাতুনের নামে। কোনো কারণে নিজের মনোনয়নপত্র না টিকলে নৌকা ডুবাতে মাকে নিয়ে থাকবেন ভোটযুদ্ধে।

আজ বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সব প্রস্তুতির কথা জানিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের সঙ্গে প্রার্থী হওয়ার সম্পর্ক নেই। কারণ দুটি ভিন্ন ঘটনা। বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছিল অন্য এক প্রেক্ষাপটে।’ প্রার্থী হওয়ায় দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য হচ্ছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এটা দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরে বোঝা যাবে। আগে তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হোক, তারপর দেখা যাবে।’

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল জানান, জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের খবর তাঁরাও পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত গাজীপুর আওয়ামী লীগের কোনো নেতার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের যোগাযোগ হয়েছে বলে তিনি জানেন না। দল থেকে জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা এটা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বিষয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগে এমন কোনো উদ্যোগ নেই। তাঁর মতে, নৌকার প্রার্থী নিয়ে তাঁরা মাঠে নেমে পড়েছেন। যেই প্রার্থী হোক নৌকার বিজয় শতভাগ নিশ্চিত।
গত ২১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এতে ‘ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার’ শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সে সময়ের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এর পরপরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মেয়র পদ থেকে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গাজীপুরের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিষয়ে তাঁকে বিতর্কিত মন্তব্য করতে শোনা যায়। এ ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এরপর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, মনোনয়নবঞ্চিত হলেও জাহাঙ্গীর আলমকে প্রার্থী হতে দল থেকে কেউ নিষেধ করেননি। তাঁদের দাবি, এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সিটি ভোটকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখতে চায়। তাই জাহাঙ্গীর আলমের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো বাধা নেই বলে দাবি করছেন তাঁর সমর্থকরা।

সিটি নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, প্রার্থী হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম ভোটের মাঠে টিকতে পারলে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়বেন নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খান। জাহাঙ্গীর মেয়র থাকাকালে নগরের রাস্তাঘাটের দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। তাঁকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে আজমত উল্লা প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়েছেন। এসব কারণে দলের ভেতরে ও বাইরে জাহাঙ্গীরের ওপর এক ধরনের সহানুভূতি রয়েছে।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) গাজীপুর জেলা শাখার আহবায়ক অ্যাডভোকেট আবদুল কাইয়ুম বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তাই বাসদসহ অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করছে। তাঁর মতে, এই সিটিতে ভোটারদের মধ্যে একটা আঞ্চলিক বিভাজন রয়েছে। আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা এবং রনি সরকারের বাড়ি একই এলাকায়। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর গাজীপুরের একক প্রার্থী।

তবে ভোটের মাঠে জাহাঙ্গীর না থাকলে আজমত উল্লার জয় অনেকটাই সহজ হতে পারে বলেও মনে করছেন স্থানীয় বিশ্লেষকরা। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, হাসান সরকারের ভাতিজা রনি সরকার প্রার্থী হলেও ভোটারদের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কম। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আহসান উল্লাহ্‌ মাস্টার হত্যা মামলায় তাঁর বাবা ও সাবেক বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকার কারাগারে রয়েছেন।

অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচিব পদে দায়িত্ব পালনকালে বেশ কিছু স্থানীয় উন্নয়নমূলক কাজে ভূমিকা রেখেছেন। তবে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তাঁর তেমন পরিচিতি নেই।
সরকার শাহ্‌ নুর ইসলাম রনি জানান, পারিবারিকভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তৃণমূলের ভোটারদের কাছ থেকেও তিনি সমর্থন পাচ্ছেন বলে দাবি করেন। রনি বলেন, বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন ও নেতাকর্মীর ওপর প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তাঁর জন্য সেটা প্রযোজ্য হবে না। কারণ, তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিএনপির কোনো পদে নেই।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. মো. মাজহারুল আলম বলেন, দল ও পরিবার পুরোপুরি ভিন্ন বিষয়। পারিবারিক সিদ্ধান্তে যে ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব, দলীয়ভাবে সেটা নেওয়া যায় না। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, এই নির্বাচনে বিএনপির জিতেও লাভ নেই। কারণ অতীত ইতিহাস বলে, গাজীপুর সিটিতে কখনোই নির্বাচিত প্রতিনিধিকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। ২০১৩ সালে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নান মেয়র পদে জয়ী হওয়ার পরও তাঁর পদ কেড়ে নিয়ে প্যানেল মেয়রের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।

ডা. মাজহার বলেন, ২০১৮ সালের ভোটেও হান্নান সরকারের জয় নিশ্চিত দেখে প্রথমে ভোট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিএনপি নেতাকর্মীর ওপর ব্যাপক ধরপাকড় চালানোর পর নির্বাচন হলেও সেখানে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টদের পুলিশ কেন্দ্র থেকে তুলে নিয়ে অনেক দূরের রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। এরপর সরকারি দলের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম মেয়র হলেও তিনি পদে থাকতে পারেননি। তাঁকেও অপসারণ করে প্যানেল মেয়র বসানো হয়েছে। তাই বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত যথার্থ।

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে প্রথমবারের মতো ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা দলীয় মনোনয়ন পেয়েও জিততে পারেননি। বিএনপি প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নান জয়ী হন। জাহাঙ্গীর আলম ওই সময়ে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন জাহাঙ্গীর আলম। এই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ছিল সাবেক এমপি হাসান সরকার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.