কার্যত ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক শিথিল। এখন তা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর যে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি চলছে, তাতে শুরুর দিকের দুটি কর্মসূচিতে জামায়াতের অংশগ্রহণ ছিল। এরপর আর কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে না জামায়াত। এ পর্যন্ত ছয়টি যুগপৎ কর্মসূচি হয়। সপ্তম কর্মসূচি হিসেবে ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি অন্য ১১টি মহানগরে যুগপৎ পদযাত্রা কর্মসূচি হয়েছে। এ কর্মসূচিতেও জামায়াত অংশ নেয়নি।
জামায়াতের ‘অভিমান’
বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে ১৪ ফেব্রুয়ারি কথা হয় জামায়াতের ঢাকা মহানগরী কমিটির দুটি অংশের একটির সেক্রেটারির সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নেতা ক্ষোভের সঙ্গেই বলেন, ‘এত দিন বিএনপি বলেছে, আন্দোলন রোজার পরে, ঈদের পরে, কোরবানির পরে। এখন তারা কর্মসূচি নিচ্ছে, কিন্তু জামায়াত নেই। অথচ জামায়াত ঐক্য চায়।’
জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনের দুই কর্মসূচির পর হঠাৎ জামায়াতের এ অনুপস্থিতি বিএনপির নেতৃত্বের ওপর ‘ক্ষোভ’ বা ‘অভিমান’ থেকে। কারণ, সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের যাত্রা বা কর্মসূচির বিষয়ে বিএনপি অন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করলেও জামায়াতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এরপরও অনেকটা গায়ে পড়ে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গত ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলে অংশ নেয় জামায়াত। এর মধ্যে ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিল করতে গিয়ে মালিবাগে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও লাঠিপেটার শিকার হন নেতা-কর্মীরা। এতে অনেকে আহত হন, অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু এ ঘটনায় বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কার্যত এর পর থেকেই জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। তবে নিজস্ব কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপির আগে বা পরে মাঠে তৎপর রয়েছে জামায়াত। যদিও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত বিএনপির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বিএনপি মনে করছে, সরকারের ওপর মানুষ দিন দিন যেভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন, তাতে জামায়াতকে ছাড়াই তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে এককভাবেই সফল হতে পারবে, এমন একটি ধারণা বিএনপির নেতাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে। এ কারণে তাঁরা যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন না।
যুগপৎ কর্মসূচি থেকে হঠাৎ জামায়াতের পিছু হটা, বিএনপির দিক থেকে সাড়া না পাওয়া—এসব বিষয়ে কথা হয় জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জনগণ সরকারের পরিবর্তন চায়। জনগণের মধ্যে এখন যে ক্ষোভের ঐক্য দেখা যাচ্ছে, তাতে এই সময়ে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য। এটা যদি কেউ পূরণ না করে, সেই দায়দায়িত্ব ওই দলের। কারণ, সরকারের টার্গেট একটাই, আন্দোলন যেন সুদৃঢ় রূপ না পায়।’
কৌশলের অংশ হিসেবে দূরত্বে বিএনপি
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদেরও আলাদা পর্যবেক্ষণ আছে। সেটি হচ্ছে, সরকারের হিংসাত্মক কার্যক্রম, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি; চাল, ডালসহ প্রতিটি জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কোনো বিরোধী দল রাস্তায় না নেমে চুপ থাকতে পারবে না। জামায়াত এ সরকারের কাছ থেকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত একটি দল। এ অবস্থায় দলটির জন্য মাঠে সরকারবিরোধী কট্টর অবস্থান নেওয়ার বিকল্প নেই।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা এ ব্যাপারে উদ্ধৃত হতে রাজি হননি। তবে তাঁরা বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এমন নয়। জামায়াতের আমির গ্রেপ্তার হওয়ার আগপর্যন্ত একটা যোগাযোগ ছিল। এ মুহূর্তে সেটি নেই।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকের (বিএনপি) সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কৌশলগত কারণে হয়তো তারা দূরত্ব রেখে চলছে। কিন্তু আমাদের দিক থেকে আমরা আগের জায়গায় আছি।’
বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কেমন হবে, সেটি নিয়ে বিএনপিতে ধোঁয়াশা আছে। যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতকে ডাকা হবে কি না, ডাকলে সেটি কীভাবে হবে—এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াতকে সঙ্গে রেখে আন্দোলন করলে বহির্বিশ্ব কীভাবে নেবে, সে ব্যাপারেও বিএনপির নেতাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয়ে একটি দেশ শুরু থেকেই নেতিবাচক। সেটি ধরেই বিএনপি এগোচ্ছে।
বর্তমানে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ‘একটা দূরত্ব আছে’ বলে স্বীকার করে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘মতাদর্শ ভিন্ন থাকলেও একটি জায়গায় আমরা একমত যে এই সরকারের অধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। ওনাদের তো এই আন্দোলন করা উচিত এবং করছেনও। এখানে কথা বলাটা জরুরি না। মাঠে থাকলে যোগাযোগ তো একভাবে না একভাবে হবেই। আজ নাহয় কাল হবে।’