জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ছে। তবে পণ্য রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেড়ে যাওয়ায় গত দুই বছরে দেশটির সঙ্গে বড় বাণিজ্যঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে আমদানির চেয়ে দেশটিতে পণ্য রপ্তানি বেশি ছিল বাংলাদেশের। তাতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে সুবিধাজনক অবস্থায়ই ছিল বাংলাদেশ।
বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে পিছিয়ে থাকলেও জাপানি বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বাংলাদেশ। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এক হাজার একর জমির ওপর গড়ে উঠছে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানে কারখানা স্থাপনে চারটি বিদেশি কোম্পানি চুক্তি করেছে। এ ছাড়া জাপানের ৩০টিসহ ৪০টি কোম্পানি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে।
দেশের ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, জাপানি কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই চীনের বাইরে বিকল্প দেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে ভিয়েতনাম ও ভারতে বিনিয়োগ করছে তারা। এই তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্যয় কম হওয়ায় এবং বিশেষায়িত খাতে কর সুবিধা, অভ্যন্তরীণ বাজার ও আঞ্চলিক বাজারে পণ্য রপ্তানির সুযোগ থাকায় জাপানি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। এ ছাড়া জাপানের বাজারেও বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর ভালো সম্ভাবনা আছে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল মঙ্গলবার চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে জাপানে গেছেন। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে অর্ধশত ব্যবসায়ী নেতার একটি দলও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কাল বৃহস্পতিবার সেখানে বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেবেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে কৃষি, মেট্রোরেল, শিল্প উন্নয়ন, জাহাজ রিসাইক্লিং, মেধাস্বত্ব, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, আইসিটি ও সাইবার–নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং শুল্ক–সংক্রান্ত চুক্তি সই হবে।
রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ
পাঁচ বছর আগে জাপান-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩০১ কোটি ডলার। এর মধ্যে আমদানি ছিল ১৫৭ কোটি ডলার, আর রপ্তানি ১৪৪ কোটি ডলার। করোনার পর জাপান থেকে পণ্য আমদানি বেড়ে যায়, সেই গতিতে রপ্তানি বাড়েনি। ফলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেটরো) বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালে সেই দেশ থেকে ১৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়। পরের বছর সেটি ৮৫ কোটি ডলার বাড়ে। গত বছর তো দেশটি থেকে আমদানি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২৬০ কোটি ডলার।
অন্যদিকে ২০২০ সালে জাপানে ১৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যা পরের বছর বেড়ে ১৪৫ কোটি ডলার হয়। গত বছর বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি দাঁড়ায় ১৭১ কোটি ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক থেকেই আসে ১০৯ কোটি ৮৫ লাখ। অন্য খাতগুলোর মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ৯ কোটি ৩৬ লাখ, হোম টেক্সটাইলে ৪ কোটি ৬৯ লাখ এবং চামড়াবিহীন জুতায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ ডলার আসে।
জাপানে পণ্য রপ্তানির ৬৪ শতাংশই তৈরি পোশাক। চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত (জুলাই-মার্চ) ১২২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছর এই বাজারে ১০৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যানুযায়ী ২০২১ সালে জাপান বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে। সেই হিসাবে এই বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি খুবই নগণ্য।
জাপানে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়া ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলে আছেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। জাপান থেকে গত রাতে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘জাপানের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে আমরা নতুন নতুন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কাল (আজ বুধবার) তেমনই এক নতুন কোম্পানির সঙ্গে আমরা বৈঠক করব।’
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, চীন থেকে জাপানিরা পোশাকের ব্যবসা সরাচ্ছে। শুরুতে তারা মিয়ানমারে গিয়েছিল। সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বাংলাদেশে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে জাপানি কোম্পানিগুলো। সে কারণে দেশটিতে রপ্তানি বাড়ছে। চলতি সফরে কৃত্রিম তন্তু উৎপাদনে জাপানি বিনিয়োগ এবং বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর শুল্কমুক্ত সুবিধার কী হবে সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
জাপানি বিনিয়োগের সম্ভাবনা
বর্তমানে বাংলাদেশে ৩২৪টি জাপানি কোম্পানির ব্যবসা রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব কোম্পানির বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ কোটি ৭৯ লাখ ডলার।
এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলে জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসার পরিস্থিতি নিয়ে গত বছর জেটরো একটি সমীক্ষা করেছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে থাকা ৭১ দশমিক ৬ শতাংশ জাপানি কোম্পানি এ দেশে ব্যবসা বাড়াতে চায়। ভারতে এই হার সাড়ে ৭২ শতাংশ, আর চীনে মাত্র ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জাপানের উদ্যোক্তারা বর্তমানে মধ্যম ও উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে বিনিয়োগ বেশি করছেন। তাঁদের জন্য দক্ষ জনশক্তি, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সমন্বিত সরবরাহ ব্যবস্থার নিশ্চয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, জাপানি উদ্যোক্তারা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করে থাকেন। অর্থাৎ তাঁরা বিনিয়োগে আসা মানেই তা বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের ব্র্যান্ডিং। এতে অন্য দেশের বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহী হবেন।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, জাপানি কোম্পানির জন্য নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য তৈরির উপাদান সংগ্রহ করে থাকে। সে জন্য জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলের আশপাশে প্রয়োজনীয় সংযোগশিল্প স্থাপনের উদ্যোগ লাগবে। তা ছাড়া জাপানি কোম্পানিগুলো নীতিনৈতিকতা মেনে ব্যবসা করে। ফলে তাদের জন্য বাংলাদেশের বিদ্যমান করপোরেট করের হার বেশি। তা কমিয়ে আনলে সেই দেশের অনেক কোম্পানি এ দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হতে পারে।