জলের কুমির যেভাবে গেল নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়চূড়ায়

0
23
জলাশয়ে কুমিরের দল। সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুমের পাহাড়ে দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন খামারে

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু পাহাড়ে গড়ে উঠেছে দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন খামার। প্রায় তিন হাজার কুমির রয়েছে এই খামারে, যার মধ্যে এক হাজারের বেশি রপ্তানিযোগ্য হলেও আইনি জটিলতায় তা আটকে আছে এক যুগ ধরে। দর্শনার্থীরা কুমির দেখতে এলেও খামারের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’—বহু পুরোনো এই বাগ্‌ধারাই বলে দিচ্ছে, এ দেশে স্মরণাতীতকাল থেকেই কুমিরের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু জলের কুমির পাহাড়চূড়ায় বসবাসের খবর যে কাউকে চমকে দিতে পারে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকার পাহাড়চূড়ায় সত্যিই দেখা মিলবে কুমিরের। তা–ও এক-দুটি নয়, কয়েক হাজার।

তুমব্রুর পাহাড়চূড়ায় রয়েছে দেশের একমাত্র বাণিজ্যিক কুমিরের খামার। ২৫ একরের ওই একটি খামারে আছে ছোট–বড় মিলিয়ে ৩ হাজার কুমির। রাস্তার পাশে একাধিক বেষ্টনীতে দেখা মেলে বাচ্চা কুমিরের লাফালাফি। কিছু বেষ্টনীতে গাছের গুঁড়ির মতো নিশ্চল পড়ে আছে কুমিরের দল। কিছু কুমির মুরগি খেতে ব্যস্ত। পাহাড়ের নিচে একাধিক জলাধারেও রয়েছে কুমির। খামারে নিয়মিত ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। ঘুরে ঘুরে কুমির দেখেন। কুমিরের জীবনচক্র জানার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ পাহাড়চূড়ায় খামার গড়ার ইতিহাস, কুমিরের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন।

সম্প্রতি নাইক্ষ্যংছড়ির ওই খামার ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। এখানকার কর্মীরা জানালেন, বিদেশে কুমির রপ্তানির উদ্দেশ্যে খামারটি গড়ে তোলা হয়। তবে এখনো মেলেনি রপ্তানির অনুমতি। এ জন্য খামারটি লাভের মুখ দেখতে পারেনি এখনো।

খামার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এপ্রিল মাস থেকে কুমিরের প্রজনন মৌসুম শুরু হয়। এখনো মৌসুম চলছে। এর মধ্যে ডিম ফুটে বেশ কিছু ছানারও জন্ম হয়েছে। এ মৌসুমে প্রায় ২০০টি ছানার জন্ম হয়েছে। আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত আরও ১৫০টি ছানা হবে। সব মিলিয়ে খামারে কুমিরের সংখ্যা দাঁড়াবে তিন হাজারের কাছাকাছি।

খামারের একটি কুমির। প্রতিদিন এসব কুমির দেখতে প্রচুর দর্শনার্থী হাজির হন। সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুমের পাহাড়ে দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন খামারে
খামারের একটি কুমির। প্রতিদিন এসব কুমির দেখতে প্রচুর দর্শনার্থী হাজির হন। সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুমের পাহাড়ে দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন খামারে

যেভাবে কুমিরের খামার

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকাটি লেক আর পাহাড়ঘেরা। এমন মনভোলানো নিসর্গের মধ্যে ২০০৮ সালে ২৫ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠা পায় দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন খামার। নাম ‘আকিজ ওয়াইল্ডলাইফ ফার্ম লিমিটেড’।

২০১০ সালে ৫০টি কুমির দিয়ে শুরু খামারের প্রজনন কার্যক্রম। এর ছয়-সাত বছরের মাথায় জন্ম নেয় দুই হাজারের বেশি কুমির। খামারে এখনো রপ্তানি উপযোগী এক হাজারের বেশি কুমির পড়ে আছে, কিন্তু আইনি জটিলতায় এক যুগের বেশি সময়ে একটি কুমিরও বিদেশে রপ্তানি করা যায়নি। তাতে খামারটি লাভের মুখ দেখছে না।

খামার কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে ৫০টি লোনাপানির কুমির দিয়ে প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ৫০টি কুমিরের মধ্যে স্ত্রী কুমির ছিল ৩১টি। গত ১৪ বছরে কুমিরগুলোর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়েছে।

প্রাপ্তবয়স্ক হতে কুমিরের সময় লাগে ৮ থেকে ১০ বছর। মাদি কুমির ৪০ থেকে ৮০টি পর্যন্ত ডিম দেয়। ডিম ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৮০ থেকে ৯০ দিন ইনকিউবেটরে রেখে বাচ্চা ফোটানো হয়। বাচ্চার বয়স দুই বছর হলে লিঙ্গ শনাক্ত করা যায়। লোনাপানির কুমির সর্বোচ্চ বাঁচে ১০০ বছর। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে খামারটি গড়ে তোলা হলেও রপ্তানি বন্ধ থাকায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। কুমির রপ্তানি করতে হলে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে।

কুমির দেখে মুগ্ধ দর্শনার্থী

সম্প্রতি খামারে গিয়ে দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ হেঁটে হেঁটে কুমির দেখছেন। মুঠোফোনে তুলছেন ছবি। কেউ কুমিরের দিকে ছুড়ে মারেন চিপস, বিস্কুট। বেষ্টনীর পাকা দেয়ালের ভেতরে থাকায় কুমির মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না।

পাহাড়চূড়ায় পাকা দেয়ালের সারিবদ্ধ ৮-৯টি কক্ষে (বেষ্টনীতে) রাখা আছে ১ হাজারের বেশি কুমির। বেশির ভাগ ছানা। ওজন ৫ থেকে ১০ কেজি। একটি কক্ষে ১০০ থেকে ২০০টি কুমিরছানা থাকছে গাদাগাদি করে। কয়েকটি কক্ষে বাচ্চার সঙ্গে দেখা মেলে বড় কুমিরও। কক্ষগুলোর ওপরে ছাউনি নেই। দর্শনার্থীরা বেষ্টনীর বাইরে দাঁড়িয়ে কুমিরের দৌড়ঝাঁপ দেখেন। প্রজনন মৌসুম বলে গত এপ্রিল থেকে দর্শনার্থীর সমাগম সীমিত রাখা হয়েছে।

খামার দেখতে হলে ৫০ টাকার টিকিট কাটতে হয়। টিকিটের গায়ে লেখা থাকে, ‘কুমির হিংস্র প্রাণী, তাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। ইট, পাথর, পানির বোতল ইত্যাদি নিক্ষেপ করবেন না। এই টিকিট ৩০ মিনিট অবস্থানের জন্য প্রযোজ্য।’

একসঙ্গে রোদ পোহাচ্ছে কুমিরের দল। সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুমের পাহাড়ে দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন খামারে
একসঙ্গে রোদ পোহাচ্ছে কুমিরের দল। সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুমের পাহাড়ে দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন খামারে

স্ত্রী ও স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলে–মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে খামার দেখতে আসেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান। আধঘণ্টা খামার দেখে মুগ্ধ পরিবারের সদস্যরা। তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে প্রথমবার খামার দেখতে এসেই মুগ্ধ হয়েছি। এ কারণে এবার পরিবার নিয়ে এলাম।’

খামারের ইনচার্জ (তত্ত্বাবধায়ক) জীবন খান বলেন, খামারে বর্তমানে কতটি কুমির আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। গণনা করাও কঠিন। ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কুমিরের পরিচর্যা করছেন। তবে সব মিলিয়ে খামারের কুমিরের সংখ্যা ২ হাজার ৯০০–এর বেশি হতে পারে।

খামারের একজন কর্মী (কুমির সংরক্ষক) বলেন, কুমিরছানাদের মুরগি আর গরুর মাংস কিমা করে দিনে একবার খাওয়াতে হয়। বড় কুমিরকে খাওয়ানো হয় সপ্তাহে একবার। পূর্ণবয়স্ক কুমিরকে বেশি খেতে দেওয়া হয় না। বেশি খেলে কুমিরের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে। তখন স্ত্রী কুমির ডিম দিতে পারে না।

প্রতি কেজি মাংস ৩০ ডলার

খামার কর্তৃপক্ষ জানায়, সরকারের অনুমতি পেলে কুমিরগুলো রপ্তানি করা হবে। রপ্তানির জন্য কুমিরের ওজন ২০ থেকে ২৫ কেজি এবং লম্বায় ৫ ফুট হতে হয়। খামারে এমন কুমিরের সংখ্যা এখন ১ হাজারের বেশি। এগুলো বিদেশে রপ্তানির উপযোগী হয়েছে। বিদেশে কুমিরের প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হয় ৩০ ডলারে। সে হিসাবে প্রতিবছরই প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ রয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে ফিরে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.