জলাবদ্ধতায় দায় কার

0
150
বৃষ্টি হয়েছে এক দিন আগে কিন্তু শুক্রবারও পানি সরেনি রাজধানীর অনেক এলাকার। নিউমার্কেট এলাকায় পানি ভেঙে ছুটছে কর্মজীবী মানুষ।

‘এমন বৃষ্টি যদি না হতো, মানুষ রাতে নৌভ্রমণের স্বাদ কীভাবে পেত! আচ্ছা, কোন শহরে তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে সড়ক হয়ে যায় সাগর?’– ফেসবুকে এমন পোস্টের সঙ্গে ভিডিও জুড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আজিমপুর নদী, ৩০ টাকায় পারাপার।’ নিছক কয়েকটি বাক্যেও সেবা সংস্থার প্রতি কতটা শ্লেষ, তা আরও স্পষ্ট ওয়ালিউর রহমান মিরাজের ফেসবুক পোস্টে, ‘বৃহস্পতিবার রাতে যারা রাস্তায় ছিল না, তারা জানবে না সত্যিকার অর্থে ঢাকা কতটা নরক ছিল!’

মিরাজ যন্ত্রণা প্রকাশে যে ছবি দিয়েছেন, তা যেন জোয়ারের অথৈ পানিতে গাড়িগুলো খড়কুটো হয়ে ভাসছে। এমনই একটি পোস্টে ফেসবুক ব্যবহারকারী অন্তু মুজাহিদের কাব্যিক মন্তব্যে চোখ আটকে যাবে, ‘পানি থৈ থৈ থৈ, মেয়র আতিক কৈ? তৈ তৈ তৈ, মেয়র তাপস কৈ?’

বিভক্ত ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র আতিকুল ইসলাম, দক্ষিণে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। দু’জনেই বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিজের পিঠ চাপটে দাবি করেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা তারা প্রায় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে কয়েক ঘণ্টায় ঝরা মাত্র ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি তাদের মুখে কাদা লেপটে দিয়েছে। রাতভর ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ সড়কে জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহালেও পাশে পায়নি মেগা সিটির দায়িত্বে থাকা কোনো সেবা সংস্থাকে।

 

 

হঠাৎ কেন এমন বেহাল অবস্থা– জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘রাজউক, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিভিল এভিয়েশন, ওয়াসা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, জেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিএডিসি, বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ– সব সেবা সংস্থারই দায় রয়েছে। শুধু দুই মেয়রকে দুষে লাভ নেই। সবাই মিলেমিশে ধ্বংস করে ফেলেছে নগর পরিকল্পনা। এখন সিটি করপোরেশন শতচেষ্টা করলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। এর পরও মেয়ররা এমন দুর্গতি হলেই সামনে আর জলাবদ্ধতা হবে না বলে যে আশার বাণী শোনান– সবই ফাঁকা বুলি, মিথ্যা আশ্বাস। কারণ, জলাবদ্ধতা নিরসনের মৌলিক জায়গা এরই মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। যেটুকু বাকি, তাও শেষ করতে সবাই উঠে-পড়ে লেগেছে। ফলে নগরবাসীর কোনো পরিত্রাণ নেই।’ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদে এমপিরা নিজ এলাকার রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ ইত্যাদির প্রয়োজন তুলে ধরেন। কিন্তু ঢাকা শহরের এমপিদের মুখে কখনও এসব যে দরকার, তা বের হয় না। তারা সোচ্চার হলে কিছুটা হলেও হয়তো সমাধান মিলত।’

জলাবদ্ধতার প্রসঙ্গ আনলে ঢাকা-১৬ (পল্লবী-কালশী) আসনের এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় বৃহস্পতিবার রাতে পানি জমেনি। যখন জমতো, সংসদে বলতাম। আমি ১১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এ সমস্যার সমাধান করেছি। একসময় কালশী, পল্লবীতে বৃষ্টি হলে গলা সমান পানি হতো। বৃষ্টি হলেই এখন পানি দ্রুত নেমে যায়।’ তবে ইলিয়াস মোল্লাহর এলাকার বাসিন্দারা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। এমনকি কালশী মোড়ে গতকাল শুক্রবারও হাঁটুপানি ছিল।

একসময় জলাবদ্ধতার জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দোষারোপ করত সিটি করপোরেশন। তবে ২০০০ সালের শেষ দিকে রাজধানীর ড্রেনেজ ও খাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের কাছে ছেড়ে দিয়েছে ওয়াসা। প্রথম দিকে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা দেখা গেলেও এ বছর তারা নিশ্চুপ। ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হলেও কোনো খাল, বক্স কালভার্ট, ড্রেন পরিষ্কার করেনি সিটি করপোরেশন। সারফেস ড্রেনেও আবর্জনার স্তূপ। মেট্রোরেলসহ রাজধানীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বিদ্যমান ড্রেনগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে একটু বৃষ্টিতেই পানি সড়কে উঠছে। রাজধানীর অনেক খাল হারিয়ে প্রায় বন্ধ পানিপ্রবাহ। দখলদাররা খাল ভরাট করে গড়েছেন স্থাপনা। মাঝে মধ্যে সিটি করপোরেশন অভিযান চালিয়ে খালের বর্জ্য অপসারণ ও দখলমুক্ত করে। তবে ক’দিন পরই আগের অবস্থায় ফিরে আসে।

জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে বৃহস্পতিবার রাতে নগরীতে জলাবদ্ধতা হয়েছে। তবে অল্প সময়েই তা নেমে গেছে। মোহাম্মদপুর এলাকায় সাধারণত ৩ মিলিমিটার পর্যন্ত জলাবদ্ধতা হলে সহজে পানি নেমে যায়। কিন্তু সাড়ে ৫ মিলিমিটার হওয়ায় কিছুটা দুর্ভোগ হয়েছে।’ তিনি স্বীকার করেন, ‘জলাশয়, খাল, বিলগুলো দিন দিন দখল, ভরাট ও দূষণের কারণে পানি সহজে নামতে পারে না। এর পরও হটস্পট চিহ্নিত করে ড্রেনের কাজ করেছি। কিন্তু পলিথিন, ময়লা-আবর্জনার কারণে ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়।’

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘নির্মিত এলাকার জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। উন্নয়নের নামে শোষণযোগ্য এলাকা আচ্ছাদিত করে ফেলছি। এখন উত্তরণের একমাত্র উপায় ওয়ার্ডভিত্তিক ১০-১২ শতাংশ এলাকায় জলাধার বা দু-তিনটি করে পুকুর করা। জমি অধিগ্রহণ করে হলেও এটি করতে হবে।’ উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডি লেক না থাকলে পুরো ধানমন্ডি এলাকা বৃহস্পতিবার পানিতে সয়লাব হয়ে যেত। লেক, খাল, পুকুরের মতো রিচার্জার পন্ড রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এলাকাভিত্তিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। পানি ধারণ করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যেটি ড্যাপেও রয়েছে।’

ভরাট খাল, ড্রেন, বক্স কালভার্ট

চলতি বছর কালুনগর, শ্যামপুর, জিরানি ও মাণ্ডা খালের প্রায় ২০ কিলোমিটার পরিষ্কার করার কথা থাকলেও সিটি করপোরেশন করেনি। খিলগাঁও খাল পরিষ্কারের এক সপ্তাহ পরই ফেরে আগের অবস্থায়। ধোলাইখাল পরিষ্কারের সুফল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কল্যাণপুরের পাঁচটি খালের প্রায় সবক’টিই দখল হয়ে গেছে। রায়েরবাজার খাল উদ্ধার করে উত্তরের মেয়র নৌকা চালালেও সেটি আবার ভরাট হয়ে গেছে। ডিএনসিসির ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার এবং ডিএসসিসির ৯৬১ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইনে কতটুকু কার্যকর, তার হিসাব নেই। ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধানে ৩৮৫ কিলোমিটার গভীর ড্রেন ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট গত দুই বছরে একবারও পরিষ্কার করা হয়নি। বর্জ্য পড়ে প্রায় পুরোটাই ভরাট হয়ে গেছে। চারটি পাম্প স্টেশনের তিনটিই অচল। জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর নেতৃত্বে গত দুই বছর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলছে। তিনিই এসব ভালো বলতে পারবেন।’ বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের বিদেশে। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানকে একাধিকবার ফোন ও এসএমএস দিলেও সাড়া দেননি। সংস্থার মুখপাত্র আবু নাছেরও কথা বলতে রাজি হননি।

স্লুইসগেট ও পাম্পগুলো বিকল

ঢাকার চারদিকের নিম্নাঞ্চলগুলো দিন দিন ভরাট হয়ে গেছে। এ জন্য স্লুইসগেট ও পাম্পের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন করতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে থাকা ১১টি পাম্পের চারটিই এখন বিকল। ৫৫টি স্লুইসগেটের মধ্যে কার্যকর মাত্র ১৮টি। সেগুনবাগিচা, মালিবাগ, পল্টন, রাজারবাগ, ফকিরাপুল, আরামবাগসহ আশপাশের পানি সেগুনবাগিচার বক্স কালভার্ট হয়ে কমলাপুর পাম্প হাউসের মাধ্যমে মানিকনগর খালে ফেলা হয়। জিরানি ও মাণ্ডা খাল হয়ে সেই পানি বালু নদী ও বুড়িগঙ্গায় পড়ে। ওই এলাকার তিনটির মধ্যে দুটি পাম্প বিকল থাকায় ভারী বৃষ্টিপাতে পুরো এলাকা তলিয়ে যায়। অন্যদিকে কাপ্তানবাজার, লক্ষ্মীবাজার, আগামাসিহ লেনসহ আশপাশের ধোলাইখাল বক্স কালভার্ট হয়ে সূত্রাপুর এলাকার পাম্প হাউসের মাধ্যমে নিষ্কাশন হওয়ার কথা। সেখানকার ৩টি পাম্পের একটি দীর্ঘদিন বিকল। দুটি পাম্প দিয়ে সেকেন্ডে ১৯ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে ভারী বৃষ্টি হলে উদ্বৃত্ত পানিতে আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে।

মিলছে না হাতিরঝিলের সুফল

সৌন্দর্যবর্ধনের সঙ্গে জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া হাতিরঝিল প্রকল্প মূল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বৃহস্পতিবারের বৃষ্টিতে হাতিরঝিলের সড়কগুলোই ডুবে যায়। যে পাইপ ড্রেন দিয়ে পানি ঝিলে প্রবেশ করবে, সেগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ঝিলের আশপাশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা পানিতে থই থই করতে দেখা গেছে। হাতিরঝিলের ১ হাজার ৮৩০ মিলিমিটার ব্যাসের আরসিসি পাইপলাইনের স্বাভাবিক ধারণক্ষমতা ও কার্যকারিতা বজায় রাখতে ১১টি স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ৪টিতে স্থাপন করা মেকানিক্যাল স্ক্রিনিং মেশিনের দুটিই বিকল হয়ে আছে। ফলে ঝিলের চারপাশেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।

হারিয়ে গেছে পুকুর, পানি যাবে কোথায়

মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর, জলাশয় ও খাল ছিল ২ হাজার। বিআইপির গবেষণা বলছে, রাজধানীতে বর্তমানে পুকুর আছে মাত্র ২৪টি। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ২০১৮ সালে ঢাকায় ১০০ পুকুর থাকলেও এখন তা ঠেকেছে ২৯টিতে। একসময় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের অন্যতম আধার ছিল এসব পুকুর। পুকুরগুলো হারিয়ে যাওয়ায় পানি নামার জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে।

রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুকুর, কমলাপুর রেলস্টেশনে রেলের ঝিল, আহমদবাগ এলাকার ঝিলের নাম মানচিত্র থেকেই মুছে গেছে। দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোও পুকুর ভরাট করে ফেলছে। গাবতলীতে বিএডিসি আর কুড়িলে বাংলাদেশ রেলওয়ে জলাধার ভরাটের উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘জলাধার রক্ষায় আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব জলাধারই ভরাট হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই যখন ভরাট করে, তখন অন্যরা কী করবে? ফলে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাজধানী।’

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মেহেদী আহসান বলেন, ‘নতুন গড়ে তোলা আবাসিক এলাকাতেও পুকুর কিংবা জলাশয় রাখা হচ্ছে না। বাড়িতে পুকুর রাখার অতীত সংস্কৃতিও হারিয়ে গেছে। এখন উচ্চবিত্তরা বাড়িতে সুইমিংপুল করছেন।’

রাজউকের বোর্ড সদস্য (উন্নয়ন) অবসরপ্রাপ্ত মেজর শামসুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘রাজউক প্রকল্প এলাকায় জলাধার রাখার চেষ্টা করে। পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পেও ১০০ কিলোমিটারের বেশি লেক রাখা হয়েছে। কাজেই রাজউক জলাধার রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.