আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থার (আইএমও) মহাসচিব হতে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে জোর প্রচার চালান বাংলাদেশের প্রার্থী মঈন আহমদ। তাঁকে জেতাতে দেশ-বিদেশে কাজ করেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী। কিন্তু আইএমওর মহাসচিব পদে নির্বাচন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রার্থীর হেরে যাওয়ার আশঙ্কায় শেষ মুহূর্তে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সূত্র জানায়।
জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা আইএমওর মহাসচিব পদে নির্বাচন হয় ১৮ জুলাই, যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। বাংলাদেশ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ছয় দেশের প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। লন্ডনে আইএমওর সদর দপ্তরে গোপন ব্যালটে সর্বোচ্চ ২১ ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হন পানামার প্রার্থী আর্সেনিও আন্তোনিও ডমিনগুয়েজ ভেলাস্কো।
জানতে চাইল মঈন আহমদ গত বুধবার (১৯ জুলাই) লন্ডন থেকে বলেন, ‘ভোট শুরুর আগে নাম প্রত্যাহার করা হয়েছে। নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার একটা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ছিল। সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি সুচিন্তিত ছিল।’
আইএমওর মহাসচিব পদে নির্বাচন উপলক্ষে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল লন্ডনে যায় বলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। নির্বাচন থেকে বাংলাদেশ কেন শেষ মুহূর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিল, এ বিষয়ে প্রতিনিধিদলটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের প্রার্থী নির্বাচনে জিতবেন কি না, তা ভোটের আগের রাতে পর্যালোচনা করা হয়। ৪০ ভোটের মধ্যে বাংলাদেশ কতটি ভোট পেতে পারে, তা বিশ্লেষণ করা হয়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রার্থীর জয়ী হওয়াটা কঠিন হবে। এরপরই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয় বাংলাদেশ।
আইএমওর মহাসচিব পদে পানামার জয়ী হওয়ার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশের এসব কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি জাহাজ নিবন্ধিত হয় পানামায়। ফলে বিশ্বজুড়ে পানামার একটা প্রভাব আছে। তা ছাড়া পানামার প্রার্থীর (আর্সেনিও) ভালো পরিচিতিও আছে। এসব কারণে তিনি সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে পরবর্তী চার বছরের জন্য আইএমওর মহাসচিব পদে জয়ী হয়েছেন।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমওর মহাসচিব পদে জিততে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রার্থী মঈন আহমদ নিজে নির্বাচনী প্রচার চালাতে সশরীর বিভিন্ন ভোটার দেশে গিয়েছিলেন। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
এ ছাড়া নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গত জুনে ফিলিপাইন সফরে যান। তখন তিনি ফিলিপাইনের যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গত ১৮ মে বাংলাদেশে কর্মরত অন্তত ২৪টি দেশের রাষ্ট্রদূতকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশের প্রার্থীকে জয়ী করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন কূটনৈতিক চ্যানেলে চিঠি পাঠানো হয়েছিল বলেও জানা যায়।
আইএমওর মহাসচিব পদের নির্বাচনে জিততে বাংলাদেশের জোরালোভাবে মাঠে নামা সম্পর্কে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের যুক্তি ছিল, এই পদে অতীতে বাংলাদেশ থেকে কেউ প্রার্থী হননি। এই পদে জয়ী হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। নৌ চলাচলে আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দেশের স্বার্থ রক্ষা সহজ হবে।
নির্বাচনটিকে ঘিরে বাংলাদেশের মোট কত টাকা খরচ হয়েছে, তা জানা যায়নি। তবে আর্থিক সংকটের মধ্যে এই খাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ খরচের যৌক্তিকতা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারকালেই প্রশ্ন ওঠে।
শেষ সময়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ জয়ী হবে কি না, তার আগাম পর্যালোচনা না করে এই নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তটি ঠিক ছিল না।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়ে মঈন আহমদ অবশ্য বলেন, ‘নির্বাচনী কাজ করতে গিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা আগামী দিনে কাজে লাগবে। তা ছাড়া এই সুবাদে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেকে জানতে পেরেছে।’
৩৭ দেশে যাবেন প্রার্থী, লাগবে ২ কোটি টাকা
মঈন আহমদ আন্তর্জাতিক মোবাইল স্যাটেলাইট অর্গানাইজেশনের (আইএমএসও) মহাপরিচালক ছিলেন। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত স্যাটেলাইটগুলোর যোগাযোগের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইএমএসও কাজ করে। জানা যায়, তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যোগ দেন। পরে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালক (কারিগরি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাচনের আগমুহূর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, এর কারণ হতে পারে তিনটি। প্রথমত, নির্বাচনে জয়ী হতে যত ভোটের দরকার ছিল, তা বাংলাদেশের ছিল না। যাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার কথা ছিল, তারা হয়তো সরে গেছে। দ্বিতীয়ত, হয়তো কারও সঙ্গে সমঝোতা করে বাংলাদেশ নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তৃতীয়ত, বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করাকেই হয়তো সরকার উত্তম মনে করেছে। ভবিষ্যতে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পরই প্রার্থী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ে ২৫ দেশের কূটনীতিক আমন্ত্রিত
জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সম্মেলনের চুক্তি অনুসারে ১৯৪৮ সালে আইএমও প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক নৌ-নিরাপত্তা, নৌ-বাণিজ্য ও নৌ চলাচলে পরিবেশদূষণ রোধে কর্মপন্থা গ্রহণের সুপারিশ করে থাকে সংস্থাটি।
বর্তমানে আইএমওর সদস্যসংখ্যা ১৭৮। এর মধ্যে কাউন্সিল সদস্যদেশ ৪০। মূলত এই ৪০ দেশই মহাসচিব পদে নির্বাচনে ভোট দিতে পারে। বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালে আইএমওর সদস্য হয়।
আইএমওর মহাসচিব পদের এবারের নির্বাচনে তুরস্ক, ডোমিনিকা, কেনিয়া, ফিনল্যান্ড ও চীনও অংশ নিয়েছিল।
আইএমওর বর্তমান মহাসচিব দক্ষিণ কোরিয়ার কিটাক লিম। তাঁর মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন দায়িত্বভার নেবেন পানামার বিজয়ী প্রার্থী।