ছেলেবেলার যে বাধা পেরিয়ে মিস ইউনিভার্স হয়েছেন ফাতিমা বশ‍

0
10
ফাতিমা বশ মেক্সিকোর টাবাস্কো প্রদেশের মেয়ে, ছবি: এএফপি

ফাতিমা বশ মেক্সিকোর টাবাস্কো প্রদেশের মেয়ে। এই মুহূর্তে তাঁকে সারা বিশ্ব একনামে চেনে, কারণ তিনি ২০২৫ সালে মিস ইউনিভার্স খেতাব অর্জন করেছেন। জানা যায়, ছয় বছর বয়সেই তিনি এডিএইচডি, ডিসলেক্সিয়া, হাইপারঅ্যাকটিভিটির মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এ সমস্যাকে যদিও স্রেফ ‘পড়াশোনায় ভালো না’ বা ‘মনোযোগ নেই’ বলে ধরা হতো; আজ সেই ভুল ধারণা ভেঙে তিনি বিশ্ব মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন।

এ উদাহরণ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমাদের সমাজে বহু শিশু ‘কিছু করার ক্ষমতা নেই’, ‘মনোযোগ নেই’, ‘ওকে দিয়ে হবে না’—এমন মন্তব্য শুনে বড় হয়।
এসব মন্তব্য শুধু তাদের মনোবলই ভাঙে না, বরং নিজের সামর্থ্য নিয়ে আজীবনের জন্য একটা সন্দেহ তৈরি করে দেয়।

অথচ ফাতিমা বশের গল্প আমাদের দেখায়—শিশুর শৈশবের ডিসলেক্সিয়া বা এডিএইচডি কোনো বাধা নয়; বরং সঠিক সময়ে সঠিক সহায়তা পেলে এই চ্যালেঞ্জগুলোই শক্তিতে পরিণত হতে পারে। শিশুর পড়াশোনার সমস্যা বা মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা মানে তার বুদ্ধি কম—এ ধারণাই ভুল।

কী এই ডিসলেক্সিয়া ও এডিএইচডি

বেশির ভাগ সময় এগুলো হলো মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের এক ভিন্ন ধরন, যা নিরাময়যোগ্য। মা–বাবা, শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা যদি লক্ষণগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখেন এবং দ্রুত সহায়তা দেন, তাহলে একটি শিশুর পুরো ভবিষ্যৎই বদলে যেতে পারে।

ফাতিমা নিজেই বলেছেন, ‘যদি আমি সেই বুলিংয়ের মুখোমুখি না হতাম, হয়তো নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখতাম না’—এ বাক্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি বাধা আদতে নতুন করে শেখার একটি সুযোগ। তিনি আরও বলেন, ‘আমার ডিসলেক্সিয়া ও এডিএইচডি ছিল কঠিন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সব মানুষের একটা বোঝাপড়া থাকে, যা আপনাকে আপনার বড় উদ্দেশ্যর দিকে ঠেলে নেয়।’

ফাতিমার এই উপলব্ধি সেসব পরিবারের জন্য আশার আলো, যারা আজ সন্তানের মনোযোগ বা শেখার সমস্যায় দিশাহারা হয়ে পড়ে। জেনে রাখা ভালো, ফাতিমার শিক্ষাজীবনও অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক। যুক্তরাষ্ট্রে এক বছর পড়াশোনা, মেক্সিকোয় ফ্যাশন ডিজাইন শেখা, পরে ইতালিতে উচ্চশিক্ষা—সব মিলিয়ে তাঁর পথচলা প্রমাণ করে দেয়, সঠিক সহায়তা পেলে যেকোনো চ্যালেঞ্জ জয় করা সম্ভব।

২০২৫ সালে মিস ইউনিভার্স খেতাব অর্জন করেছেন ফাতিমা
২০২৫ সালে মিস ইউনিভার্স খেতাব অর্জন করেছেন ফাতিমাছবি: এএফপি

অভিভাবকদের জন্য

আপনার শিশুর আচরণে যদি এমন কোনো লক্ষণ বারবার দেখা যায়—

  • হঠাৎ মনোযোগ হারানো, ক্লাসে স্থির হয়ে বসে থাকতে না পারা, পড়ার সময় অক্ষর বা শব্দ চিনতে সমস্যা, কিংবা পড়তে গিয়ে দ্রুত হতাশ হয়ে পড়া, তাহলে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।
  • পড়াশোনায় অক্ষর বা শব্দ চিনতে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি সময় নিচ্ছে কি?
  • বারবার বানান ভুল করছে?
  • কবিতা বা পড়া মনে রাখতে কষ্ট হচ্ছে?
  • ক্লাসে খুব সহজেই মনোযোগ ছুটে যাচ্ছে?
  • কোনো কাজ শুরু করেও শেষ করতে পারছে না?
  • নির্দেশনা বুঝতে বারবার সমস্যা হচ্ছে বা ভুল করছে?

এ ধরনের লক্ষণ কয়েক মাস ধরে স্পষ্ট থাকলে এটি শুধুই ‘দুষ্টুমি’ নয়, বরং নিউরোডেভেলপমেন্টাল কোনো সমস্যার ইঙ্গিতও হতে পারে।

করণীয় কী

শিশুর ডিসলেক্সিয়া, এডিএইচডি বা মনোযোগজনিত সমস্যাগুলো সঠিক যত্নে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে এবং শিশুর সক্ষমতা দ্রুত উন্নত হয়। এ ক্ষেত্রে যা জরুরি—

  • সঠিক শনাক্তকরণ: মূল্যায়ন, স্ক্রিনিং, ইউনিট-চেক ইত্যাদির মাধ্যমে সমস্যার প্রকৃতি বুঝে নেওয়া।
  • বিশেষায়িত থেরাপি: মাল্টিসেন্সরি লার্নিং, ফোকাস-বেজড লার্নিং, ধাপে ধাপে শেখানো—এসব পদ্ধতি পড়ার দক্ষতা ও মনোযোগ উভয়ই বাড়ায়।
  • গোছানো পরিবেশ: রুটিন তৈরি, ছোট কাজ ভাগ করে দেওয়া, পড়ার মাঝে ছোট বিরতি নেওয়া—এগুলো শিশুকে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সহায়তা করে।
  • মা–বাবার সক্রিয় ভূমিকা: নিয়মিত প্রশংসা, শিশুর প্রচেষ্টাকে মূল্য দেওয়া—এগুলো শিশুর আত্মবিশ্বাস তৈরিতে অপরিহার্য।
  • স্কুল-বাড়ির সমন্বয়: শিক্ষককে শিশুর চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানানো এবং প্রয়োজনে বাড়তি সময় বা সহায়ক শিখনপদ্ধতির অনুরোধ করা।
  • অনুভূতিগত সহায়তা: শিশুকে জানিয়ে দেওয়া—‘তুমি পারবে’, ‘এটা তোমার সীমাবদ্ধতা নয়’। এ ধরনের বার্তা তার মানসিক শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

ফাতিমা বশের এ জয় শুধু একটি খেতাব জয়ের গল্প নয়; এটি আমাদের শেখায়, ভিন্নভাবে কাজ করা মস্তিষ্ক কিন্তু কম সক্ষম নয়। আমাদের সমাজে এমন অনেক শিশু আছে, যাদের আজ হয়তো বলছেন ‘ব্যর্থ’; কিন্তু হয়তো সামনের দিনে সেই শিশুই হবে দেশের গর্ব, হয়তো হয়ে উঠবে তারকা।

চিকিৎসা, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং পরিবারের সহায়তা—এই তিনটি মিলেই শিশুর শেখার সমস্যা বা মনোযোগহীনতা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

ডা. টুম্পা ইন্দ্রানী ঘোষ, শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের সিনিয়র ক্লিনিক্যাল ফেলো

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.