২০২৪ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিকের তুলনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটি কম হওয়ায় প্রায় ৪ লাখ প্রাথমিক শিক্ষকের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ২১ ডিসেম্বর ছুটির ওই তালিকা প্রকাশ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে দেখা যায়, ২০২৪ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ৬০ দিন। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে ছুটি ৭৬ দিন।
প্রাথমিকের ৬০ দিন ছুটির মধ্যে দুই ঈদ, দুর্গাপূজা, গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন ছুটি ৪৩ দিন। বাকি দিনগুলো সরকারি ও অবৈতনিক ছুটি। সাপ্তাহিক বন্ধ দুই দিন (শুক্র ও শনিবার) ধরে এ তালিকা করা হয়েছে।
ছুটির এই তালিকা প্রকাশের পর থেকে প্রাথমিকের শিক্ষকরা নানাভাবে আপত্তি জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, নতুন পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুসারে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাথমিকের ছোট শিশুরা বেশি ছুটি পাওয়ার কথা। অথচ হয়েছে তার উল্টো!
শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ২০২৪ সালের ছুটির বর্ষপঞ্জিকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের ছুটি ৭৬ দিন। প্রাথমিকের শিক্ষকদের বক্তব্য, নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটি বছরে ৭৬ দিন রাখার বিধান রয়েছে। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তা মানেনি। বড়দের ছুটি ৭৬ দিন হলেও ছোট্ট শিশুদের ক্ষেত্রে তা ৬০ দিন করা হয়েছে!
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বয়হীনতা দীর্ঘদিনের। দুই মন্ত্রণালয় আলোচনা করে ছুটির বর্ষপঞ্জিকা তৈরি করলে কোনো প্রশ্ন উঠত না।
প্রকাশিত বর্ষপঞ্জি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রমজানের ছুটি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রমজানের ছুটি ২৯ দিন হলেও প্রাথমিকে তা ২১ দিন। পঞ্জিকা অনুসারে ২০২৪ সালে প্রাথমিকে ছুটির মধ্যে রয়েছে– রমজান, ঈদুল ফিতর, জাতীয় শিশু দিবস, বাংলা নববর্ষসহ আরও কয়েকটি ছুটি মিলে ১২ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত একসঙ্গে ২১ দিন। এর পর ১৩ থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত সাত দিন গ্রীষ্মকালীন ছুটি। ১১ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ দিন দুর্গাপূজা এবং ১২ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ দিন শীতকালীন ছুটি। বাকি ২৭ দিন সরকারি ও অন্যান্য ছুটি পাবে সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা।
সারাদেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে সাড়ে ৩ লাখ সহকারী শিক্ষক ও সাড়ে ৬৫ হাজার প্রধান শিক্ষক রয়েছেন। এই বিদ্যালয়গুলোতে ১ কোটি ৪০ লাখ শিশু পড়াশোনা করে। নতুন বছরের ছুটি নিয়ে এই শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ। চলতি বছর প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হলেও প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের ছুটির তালিকা কেন দুই রকম হলো– জবাব মিলছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটি আগের বছরের চেয়ে ২২ দিন কমিয়ে ৫৪ দিন করা হয়। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষকের হাতে তিন দিন সংরক্ষিত ছুটি রাখা হয়। তবে তা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার অনুমোদন নিয়ে ভোগ করতে হয়েছে। নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বছরে ৭৬ দিন ছুটির কথা বলা আছে। শিক্ষকরা বলছেন, মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিকে ছুটি কম হওয়ায় এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যেমন– ২০২৪ সালের রমজান মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ২১ দিন রেখেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অথচ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর রমজানের ছুটি রেখেছে ২৯ দিন। পবিত্র ঈদুল আজহায় প্রাথমিকে ছুটি সাত দিন রাখা হলেও মাধ্যমিকে তা ১৪ দিন। দুর্গাপূজায় প্রাথমিকে ছুটি ৫ দিন হলেও মাধ্যমিকে ৭ দিন।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল বিভাগের সমন্বয়ক কামরুল হাসান বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী। এ কারণে তারা শ্রান্তি বিনোদন, অর্জিত ছুটিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। তবে একই কারিকুলাম হওয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ছুটি এক এবং অভিন্ন হওয়াই যৌক্তিক।’
প্রধান শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ক রঞ্জিত ভট্টাচার্য বলেন, ‘শুধু রমজানের ছুটির ক্ষেত্রে নয়, দুর্গাপূজার ছুটিতেও বৈষম্য করা হয়েছে। শিক্ষার মান উন্নয়নের স্বার্থে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ছুটি অবশ্যই সমন্বয় করা উচিত।’
ছুটি নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সম্পাদক স্বরূপ দাস বলেন, ‘অনেক পরিবারের একাধিক সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়াশোনা করে। ছুটির ভিন্নতা থাকলে ওইসব পরিবার সমস্যায় পড়ে। তাই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছুটির দিন অভিন্ন হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিকের ছুটি সব সময় কম থাকে। কারণ মাধ্যমিকে পরীক্ষা বেশি, পাবলিক পরীক্ষার কারণে তাদের বিদ্যালয় এমনিতেই বন্ধ রাখতে হয়। সে সময়গুলোতে তাদের ছুটি থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গতবারের চেয়ে এবার আমাদের ছুটি বরং বেড়েছে। গতবার রমজানে ৯ দিন খোলা ছিল। এবার তা কমানো হয়েছে।