ছাত্রদের আন্দোলনে যে গান হয়ে উঠছে প্রতিবাদের হাতিয়ার

0
52

গানের আছে এক সম্মোহনী শক্তি; যা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, আবেগে ভাসিয়ে দেয়, শিকড়কে চেনায়, তুলে ধরে জীবনের অর্থ। একইভাবে গানই খুঁজে দেয় মুক্তির পথ। সংগীত কীভাবে মুক্তিকামী মানুষের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ ১৯৭১।

সম্মুখ যোদ্ধাদের সাহস-শক্তি জোগাতে, স্বাধীন দেশের মানচিত্র ছিনিয়ে আনতে সে সময় গানই হয়ে উঠেছিল বড় হাতিয়ার। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর আরও একবার সেই সত্য নতুনভাবে উঠে এসেছে আমাদের মাঝে। শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র চলমান সহিংসতা একদিকে যেমন লাখো জনতাকে রাজপথে নামিয়েছে, তেমনি সংগীতযোদ্ধাদের কণ্ঠে তুলে দিয়েছে বিদ্রোহের সুর; যা মানুষের মনে আঁচড় কাটার পাশাপাশি শোনিত ধারায় বইয়ে দিচ্ছে অগ্নিস্রোত।

সহিংসতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা সাত সুরের সেসব গান হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের হাতিয়ার। তাই সেসব গানের শিল্পী, গীতিকবি, সুরকার, সংগীতায়োজক তারকা নাকি আনকোরা কেউ– সেই প্রশ্ন আর মুখ্য হয়ে থাকেনি। যে কারণে হান্নান নামের এক তরুণ র্যা পারকে আমরা দেখেছি প্রতিবাদী শিল্পীদের সামনের সারিতে। সংগীতের মান বিচার নয় বরং তাঁর গাওয়া ‘আওয়াজ উডা’ গানটিকে সবাই উল্লেখ করছেন সময়ের সাহসী উচ্চারণ হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে এ  গানের শুরু ও শেষ। মাঝের অংশে সাম্প্রতিক ঘটনা সরকারের বিরুদ্ধে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য প্রশ্ন? যা শ্রোতা মনে অগ্নিঝড় বইতে দিতে সময় লাগেনি।

১৮ জুলাই গানটি প্রকাশের পর পরই তা রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়। ‘আওয়াজ উডা’ গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে হান্নান লিখেছিলেন, ‘আমরা কোনো সংস্থার বিরোধিতা করছি না। এর পরিবর্তে আমরা আমাদের সমবয়সীদের কণ্ঠকে প্রসারিত করতে চাই এবং আমাদের দেশকে প্রভাবিত করে এমন সমস্যাগুলোর ওপর আলোকপাত করতে চাই।’ এমন কথা লেখার পরও শেষ রক্ষা হয়নি হান্নানের। পড়তে হয়েছে সরকারের রোষানলে। গ্রেপ্তার ছাড়াও এই তরুণ র্যা পারকে রিমান্ডে নিতে এক মুহূর্ত দেরি করেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এদিকে শুরু থেকেই রাজপথে আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন কণ্ঠশিল্পী সায়ান। যিনি বহুবছর ধরেই গানে গানে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা অসংগতির কথা তুলে ধরছেন। এবার তাঁর গানে উঠে এসেছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শহীদের কথা। শহীদ আবু সাঈদ ও ফাইয়াজদের নিয়ে গাওয়া তাঁর নতুন গানটি শুনে অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন। একইভাবে তরুণ শিল্পী পারসা মাহজাবীনের গাওয়া ‘চলো ভুলে যাই’ গানটিও আন্দোলিত করেছে কয়েক লক্ষ শ্রোতার হৃদয়। চব্বিশের গেরিলা নামের একটি গানের দলের স্বনামে প্রকাশিত গানটি হয়ে উঠেছে চলমান ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার।

তরুণ শিল্পী সেজানের গাওয়া ‘কথা ক’ গানটিও এখন আন্দোলনকারীদের মুখে মুখে ফিরছে। ওয়ারফেইজ ব্যান্ডের সাবেক তারকা গিটারিস্ট অনি হাসানের কম্পোজিশনে কাজী জোহাদ ইয়াদানীর গাওয়া ‘আমরা বীর’ গানও প্রকাশের পরপরই সাড়া ফেলতে শুরু করেছে।

এ ছাড়া কোল্ডক্রাফটের ‘বায়ান্ন’, অ্যাজ অমিক্সে ‘রক্ত’, ম্যাক-ই-ম্যাক ও জিকে কিবরিয়ার ‘স্লোলাগান’ ও ‘ইনকিলাব’, সিয়াম ফারদিনের ‘আবু সাঈদ’, নাহিদ হাসানের ‘জবাব দেনা’, রেভ্যুলেশন ইন মোশনের ‘পাল্টে দে ইতিহাস’, ভয়েস অব রেভ্যুলেশনের ‘রাজাকার’, লুনাটিক্স বীর ও রিদমাস্ত্রের ‘দেশ কার’সহ প্রকাশিত আরও বেশ কয়েকটি গান এখন চলমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এখানেই শেষ নয়, নব্বই ও শূন্য দশকে প্রকাশিত দেশের প্রথম সারির ব্যান্ড মাকসুদ ও ঢাকার ‘আবার যুদ্ধে যেতে হবে’, আর্কের ‘আর কত মৃত্যু’, ওয়ারফেজের ‘জনস্রোত’ গানগুলো প্রতিবাদী জনতার মাঝে নতুন করে সাড়া ফেলতে শুরু করেছে। যা এটাই প্রমাণ করেছে, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, ইতিহাসের পটপরিবর্তনে গান বুলেট, বোমার মতো যে আগ্নেয়াস্ত্রের মতোই বড় এক হাতিয়ার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.