চ্যালেঞ্জ থাকলেও ইউরোপের বাজারে অনেক সম্ভাবনা

ইইউতে পোশাক রপ্তানি

0
159
তৈরি পোশাক কারখানা

দেশের মোট রপ্তানি আয়ে সমজাতীয় পণ্যসহ তৈরি পোশাকের হিস্যা এখন ৮৬ শতাংশ। এ পণ্যগুলোর প্রধান বাজার ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বাংলাদেশের পোশাকের বাজার হিসেবে ইইউর হিস্যা ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইইউ বাজারের গুরুত্ব প্রমাণ করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বেশ কিছু সুবিধায় ইইউতে পোশাক রপ্তানি আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এমনকি মাত্র সাত বছর অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যেই এটি ৬ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইইউতে ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।

রপ্তানি বাড়ানোর সম্ভাবনা কতটা

ইইউ জোটে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে একসঙ্গে এখন অনেক সম্ভাবনার দুয়ার বাংলাদেশের সামনে খোলা। যেমন– ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পোশাকের চাহিদা গড়ে ৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। বর্তমান বাজার ২০০ বিলিয়ন ডলারের। বর্ধিত এ চাহিদায় বাংলাদেশের হিস্যা একরকম একচেটিয়া। কারণ জোটে চীনা আধিপত্য ক্রমে কমছে। মার্কিন বৈরিতা সূত্রে তাদের মিত্র ইইউর বাজারে চীনা পণ্য অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রায় একই নিয়তি বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামেরও।

নিজস্ব নীতির কারণেও পোশাক বাণিজ্য থেকে সরে আসছে চীন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান সে কথাই বলছে। গত ২০২২ পঞ্জিকা বছরে ইইউ জোটের দেশগুলোতে পরিমাণে বেশি পোশাক রপ্তানিতে প্রথমবারের মতো শীর্ষস্থান দখলে এনেছে বাংলাদেশ। বছরটিতে ১৩৩ কোটি কেজি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। চীন করেছে ১৩১ কোটি কেজি। পরিমাণের হিসাবে বাংলাদেশের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির হার চীনের প্রায় দ্বিগুণ। পরিমাণের হিসাবে আগের বছরের চেয়ে গত বছর রপ্তানি বেশি হয়েছে ২১ শতাংশ, চীনের যা ১২ শতাংশের কম। অর্থমূল্যে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে চীনের দ্বিগুণ হারে। অর্থমূল্যে গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ, যেখানে চীনের এ হার ১৭ শতাংশ। ইইউতে রপ্তানিতে সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিই সবচেয়ে বেশি। পোশাকের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা ভিয়েতনাম আরও বড় ব্যবধানে পিছিয়ে আছে। ইইউতে পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনামের অবস্থান পঞ্চম।

ইইউতে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের মজবুত ভিত্তির আরও একটি উদাহরণ হচ্ছে দরের হিসাব। সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভিয়েতনামের পোশাকের চেয়ে বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেড়েছে বেশি হারে। আগের বছরের চেয়ে গত বছর ইইউতে বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। যেখানে চীনের পোশাকের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশের কিছু কম। ভিয়েতনামের বেড়েছে ৩ শতাংশের মতো। ওই বছর ইইউভুক্ত দেশগুলোতে পোশাকের দাম বেড়েছে গড়ে ৩ শতাংশ হারে। অর্থাৎ দেশের চেয়ে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেশি হারে বাড়ছে। ইইউর সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদন ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশের মজবুত এ ভিত্তির পেছনে অন্যতম শক্তি পোশাকের পশ্চাৎসংযোগ শিল্প। বিশেষ করে নিট ক্যাটেগরির পোশাকই ইইউতে বেশি রপ্তানি হয়। নিটের সুতা ও কাপড়ের প্রায় শতভাগ স্থানীয়। এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পোশাক খাতের জন্য ইইউ শুধু বড় বাজারই নয়; একই সঙ্গে সুবিধাজনক বাজার। কারণ নিট পোশাক সাধারণত ওজনে কিছুটা ভারী হয়ে থাকে। এ কারণে ফ্রেইট কস্ট বা পরিবহন ব্যয় বেশি। সেদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা দীর্ঘ পথের অন্যান্য দেশে পরিবহন সাশ্রয়ী হয় না। তুলনামূলক কাছের হওয়ায় ইউরোপে রপ্তানি সুবিধাজনক। এ ছাড়া শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানিতে ইইউতে উৎস বিধির শর্ত অন্য যে কোনো বাজারের চেয়ে অনুকূল। যে কোনো দেশের কাঁচামাল এনে পোশাক রপ্তানি করা যায়।

ইইউর মতো বড় বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার এখনও করতে পারেনি বাংলাদেশ। সম্ভাবনার অন্তত ৪০ শতাংশ এখনও অব্যবহৃত। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য না থাকায় এত বড় বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগছে না। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) এক গবেষণায় বলা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে ইইউর বাজারে ৬০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব। পোশাকের বৈশ্বিক বাজারের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এ পরিসংখ্যান দিয়েছে র‍্যাপিড। গবেষণায় বলা হয়, বর্তমান অবস্থায়ও ইইউতে বাড়তি ১৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। তবে সক্ষমতার অভাব এবং পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতার কারণে সুযোগ কাজে লাগছে না। ইইউ জোটে রপ্তানি পণ্যের ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। পোশাকবহির্ভূত বড় পণ্যের সম্ভাবনার ২৫০ কোটি ডলার কম রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাদুকা, চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইলস, চিংড়ি ও মাছ।

পণ্যে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ

ইইউর বাজার সম্পর্কে তথ্য-উপাত্তের অভাব রয়েছে। জোটের কোন দেশে কী সম্ভাবনা, কোন মৌসুমে কী রঙের পোশাকের চাহিদা থাকে– এ বিষয়ে জানা-বোঝার স্বল্পতা রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানের প্রশ্নে উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টিও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আবার রপ্তানির বিপরীতে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তা সব পণ্যের ক্ষেত্রে সমান নয়। এ কারণে অনেক পণ্যের উদ্যোক্তা রপ্তানিতে উৎসাহিত নন। তুলনামূলক লাভজনক দামে স্থানীয় বাজারেই বিক্রিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তারা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ক্ষেত্রে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সরবরাহ চেইনে বিভিন্ন সেবার সহজলভ্যতার অভাবেও বৈচিত্র্য আনার বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কিছু সুবিধা থাকবে না

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এলডিসি হিসেবে পাওয়া শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা আর থাকবে না। রপ্তানি উৎসাহিত এবং সক্ষমতা বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া নগদ সহায়তা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে তিন ধরনের কাঠামোতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হয় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে। আটটি পণ্যে ২০ শতাংশসহ ৩৮টি পণ্যে বিভিন্ন হারে নগদ সহায়তা রয়েছে। এসব বিধিবিধান পরিপালনের কারণে রপ্তানি সক্ষমতা কমতে পারে। ২০২৬ সালে এলডিসির পরিচয় ঘুচবে বাংলাদেশের। ইইউ জোটের ২০২৯ সাল পর্যন্ত এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) কর্মসূচির অধীন যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে। ইবিএ হচ্ছে সবচেয়ে সহজ শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধা, যা এলডিসিগুলো পেয়ে থাকে।

পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ এলডিসি-উত্তর পরবর্তী সময়ে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে। সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, রাষ্ট্রদূত এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফোরামের সঙ্গে আলোচনায় এ দাবি তুলে ধরেছেন। তারা আশাবাদী শেষ পর্যন্ত একটি স্বস্তিদায়ক অবস্থায় যেতে পারবেন। বিজিএমইএর এ আবেদন আমলে নেওয়া না হলেও ‘জিএসপি প্লাস’ নামে ইইউর আরেকটি শুল্কমুক্ত সুবিধার স্কিম রয়েছে, যাতে প্রায় একই রকম সুবিধা ভোগ করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। তবে এ জন্য কিছুটা কঠিন শর্ত পরিপালন করতে হবে। এ-সংক্রান্ত ৩২টি কনভেনশন অনুমোদন করার শর্ত রয়েছে। এ পর্যন্ত ২০টি কনভেনশন অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ। বাকি ১২টিও অনুমোদন করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে– বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা, নির্যাতন ও অন্যান্য নৃশংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক ও র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সুশাসন, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের পাশাপাশি পরিবেশ, সামাজিক ও সুশাসন (ইএসজি) কমপ্লায়েন্সের শর্ত যদি জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেলে তারপর তা রক্ষা করার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। মানবাধিকার, শ্রম অধিকার কিংবা অন্য যে কোনো ইস্যুতে অগ্রগতি সন্তোষজনক মনে না করলে যে কোনো সময় শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহারের এখতিয়ার রয়েছে ইইউর। এ ছাড়া কার্বন করও বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের হুমকি। ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৫৫ শতাংশ কমানো এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি পথনকশা করেছে ইইউ। ‘ইইউ গ্রিন ডিল’ নামের এ পদক্ষেপের আওতায় কয়েকটি খাতের পণ্যের ওপর কার্বন কর আরোপ করার কাজ চলছে। ২০২৬ সালে আমদানি পর্যায়ে এ শুল্ক আরোপ করা হবে। আটটি আমদানি পণ্যের ওপর এটি আরোপ করা হতে পারে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা প্রাথমিক তালিকায় রাখা হয়নি। তবে ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের এই তিন পণ্যে কার্বন কর আরোপ হতে পারে। এ কর আরোপ হলে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে।

আবু হেনা মুহিব

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.