চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে ফের তৃণমূলে যাচ্ছে বিএনপি

0
125
তৃণমূল

জনইস্যুতে ধারাবাহিক কর্মসূচির সিদ্ধান্ত

সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে আবারও তৃণমূলে যাচ্ছে বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে নিজেদের আরও শক্তিশালী ও সুসংহত করতে চায় দলটি। এক দফার আন্দোলনে যাওয়ার আগে তৃণমূল পর্যায়ে ইস্যুভিত্তিক আরও ধারাবাহিক কর্মসূচি দেবে বিরোধী দলটি। আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি দাবির সপক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও নিজেদের শক্তি জানান দিতে চায় দলটির হাইকমান্ড। লক্ষ্য অর্জনে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে চলমান কর্মসূচি আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী দলগুলো। একেবারে তৃণমূল থেকে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, গণঅবস্থান, গণসমাবেশ, সমাবেশ, পথযাত্রার মতো কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ‘বড় সমাবেশ’ করার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির।

সংবিধান অনুযায়ী আগামী আট মাস পর, অর্থাৎ ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। সে অনুযায়ী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে ঘোষণা হতে পারে নির্বাচনের তপশিল। তপশিলের আগের চার মাসের মধ্যেই আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে চায় টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। সে লক্ষ্যে আগামী দু-তিন মাসে তৃণমূল থেকে আন্দোলনের ঢেউ তুলতে চায় তারা। তারপর ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে একই ইস্যুতে আন্দোলনে ব্যর্থ বিরোধী দলটি।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তাঁদের আন্দোলনটা বিএনপিকে ক্ষমতায় নেওয়ার জন্য নয়। দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার ফিরে পেতে তাঁরা আন্দোলন করছেন। এ আন্দোলনে যেমন বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের নেতাকর্মী রাজপথে আছেন, তেমনি সাধারণ মানুষও আছেন। আগামীতে জনগণের সম্পৃক্ততা আরও বেশি বাড়াতে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁদের সমর্থনেই চলমান আন্দোলন সফল হবে বলে জানান তিনি।

গত জুলাই থেকে সরকারের পদত্যাগ দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে বিএনপি। ওই আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৭ নেতাকর্মী নিহত ও অসংখ্য আহত হন। কারাগারেও যেতে হয়েছে উল্লেখযোগ্য নেতাকর্মীকে। জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে গুলি করে নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ধারাবাহিক ওই আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারাদেশে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করে দলটি। সরকারের বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এসব সমাবেশ সফল করলেও ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় বাহ্যিকভাবে অনেকটা ব্যাকফুটে যায় দলটি।

দলটির নেতাদের মতে, সারাদেশে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে যেভাবে তাঁরা গণজাগরণ সৃষ্টি এবং জনসম্পৃক্ততা ঘটাতে পেরেছিলেন, তাতে অনেকটাই ছেদ ঘটে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায়। যদিও এর পরে ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে রাজপথে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছেন তাঁরা। কিন্তু সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের জন্য তাঁদের আবারও জনমত তৈরির কর্মসূচিতে যেতে হবে। জনগণকে মাঠে নামাতে হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সুশীল আর বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় করতে হবে। এ লক্ষ্যে আবারও একেবারে তৃণমূল থেকে শুরু করতে চাইছেন বিএনপির হাইকমান্ড।

এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রমজান মাসেও কর্মসূচির মাধ্যমে সক্রিয় অবস্থান ধরে রাখে দলটি। সারাদেশে ইউনিয়ন থেকে শুরু করে থানা-উপজেলা. জেলা পর্যায়ে গণঅবস্থান, মানববন্ধন, প্রচারপত্র বিলির মতো কর্মসূচি পালন করেন নেতাকর্মী। এর বাইরে সারাদেশে শতাধিক ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ব্যানারেও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এর মাধ্যমে সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচারসহ অন্যান্য অসংগতি তুলে ধরে দলটি। ইফতারে দলের নেতাকর্মী ছাড়াও পেশাজীবী, সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়। এ ছাড়া গুম, খুন আর নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়ানোর কর্মসূচিও গ্রহণ করে দলটি। কারাগারে আটক নেতাকর্মীকে সাহস জোগাতে কেন্দ্রীয় নেতারা ছুটে যান তাঁদের বাড়ি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঈদ উপহার পৌঁছে দেন তাঁরা। এর মাধ্যমে নেতাকর্মীর মনোবল আরও সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নেয় দলটি।

দলের একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য জানান, সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি সম্পর্কে আলোচনা চলছে। নেতাকর্মীকে সক্রিয় রাখা এবং কোন জায়গায় কী ধরনের দুর্বলতা রয়েছে, তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। সেখানে সক্ষমতা বাড়ানোরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেসব জায়গায় কোন্দল, নেতৃত্বশূন্যতা এবং প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেসব জায়গায় কীভাবে দুর্বলতা দূর করা সম্ভব, তা নিয়ে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সবকিছু সম্পন্ন করেই তাঁরা এক দফার আন্দোলনে নামতে চান। শুধু দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা নয়; অন্যান্য দলের মতামত, তাদের চাওয়া-পাওয়াকে সমন্বয় করা হচ্ছে। কূটনৈতিক মহল, প্রশাসন– সর্বত্র তাঁদের কাজ চলছে। সবকিছু গুছিয়ে তাঁরা চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবেন। এ জন্য তাঁদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলমান থাকবে। সবকিছু ঠিক থাকলে চূড়ান্ত আন্দোলনের রোডম্যাপ ঠিক করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট নেতারা।

বিএনপি নেতারা জানান, এবারের আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে ঢাকা মহানগর বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ছাড়াও শ্রমিক দলকে আরও বেশি সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের শক্তিমত্তা পরীক্ষা করতে নিয়মিত কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত রয়েছে তাঁদের। মহানগরকেন্দ্রিক ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি অঙ্গ সংগঠনগুলোকেও পৃথক কর্মসূচিতে মাঠে নামানোর কৌশল রয়েছে দলটির। ঈদের আমেজ শেষ হওয়ার পরপরই এ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামবেন তাঁরা। এর মধ্যে আগামী পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসকে টার্গেট করে ঢাকায় বড় ধরনের শোডাউন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া সরকারবিরোধী আন্দোলন ও আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে করণীয় ঠিক করতে নিয়মিত কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামত নেবেন দলের হাইকমান্ড। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতেই আগামী দিনের এক দফার আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে এ বৈঠকের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় দলকে।

জানা গেছে, আগামীর আন্দোলনের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপিকে আরও বেশি সক্রিয় করতে নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দলটির নেতাদের মতে, যে কোনো সময়ের চেয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি যথেষ্ট শক্তিশালী। এখন এই সংগঠনের ওপর ভিত্তি করে আন্দোলনে যাওয়া যেতে পারে। তবে মহানগর বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে আরও নিশ্চিত হতে চাইছেন দলের হাইকমান্ড। চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে আরেকটি মহড়া দিয়ে নিতে চান তাঁরা। একই সঙ্গে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনকেও বেশিমাত্রায় সক্রিয় করতে পৃথক উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।

সূত্র জানায়, আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রদল একেবারে ইউনিয়ন থেকে শুরু করে পৌর, থানা, জেলা ও বিভাগীয় সমাবেশের জন্য নিজেদের তৈরি করছে। একইভাবে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলকেও প্রস্তুত করা হচ্ছে। সম্প্রতি যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এখন এসব সংগঠনের নেতাদেরও কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে।

দলটির নেতাকর্মীরা জানান, প্রতিনিয়ত এবং ধারাবাহিক কর্মসূচিতে তাঁরা ক্লান্ত হলেও রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছেন। হামলা-মামলার শিকার হয়ে তাঁদের মধ্যে আরও বেশি সাহস সঞ্চার হচ্ছে। যে কোনো প্রতিবন্ধকতায় প্রতিরোধ গড়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। এখন যতই নির্যাতন আসুক; অস্তিত্বের প্রয়োজনে তাঁরা সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামতে চান। দলের হাইকমান্ড থেকেও তাঁদের কাছে এমন বার্তা রয়েছে। প্রতিটি কর্মসূচিতে তাঁদের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ত্যাগের ভিত্তিতে মূল্যায়নের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এতে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মী অনেক বেশি উজ্জীবিত।
মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক জানান, দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনা; খালেদা জিয়াসহ সব নেতাকর্মীর মুক্তির জন্য ওই আন্দোলনে তাঁরা জীবন বাজি রাখতে চান। তাঁরা যে কোনো কর্মসূচি পালনে প্রস্তুত। এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছেন নেতাকর্মী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.