খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজি ১২৫-১৩০ টাকা
চিনির দর নিয়ে ‘ছিনিমিনি’ থামছেই না। আমদানি শুল্ক ছাড়ের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেজিতে ৩ টাকা কমিয়ে খোলা চিনি ১০৪ এবং প্যাকেটজাত ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু বাজারে চিনির দাম তো কমেইনি, উল্টো লাফিয়ে বেড়েছে।
তিন দিন আগে হঠাৎ সংকটের অজুহাতে খোলা চিনি ১৩০ টাকা হয়। এরপর কিছুটা কমলেও গতকাল মঙ্গলবার খুচরা বাজারে ফের ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর সেগুনবাগিচা, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরসহ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে এ তথ্য জানা গেছে। দাম বৃদ্ধির জন্য খুচরা ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, বাজারে এখন কিছু চিনি পাওয়া যাচ্ছে ফ্রেশ ও নাম্বার ওয়ান ব্র্যান্ডের। পাইকারি পর্যায়েই তাঁদের ৫০ কেজির বস্তা খোলা চিনি কিনতে হচ্ছে ৫ হাজার ৮০০ টাকায়, সপ্তাহখানেক আগেও যা ৫ হাজার টাকার আশপাশে ছিল। একটি কোম্পানি ছাড়া কেউই চিনি দিচ্ছে না। ফলে বাজারে সংকট রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে সয়াবিন তেল নিয়ে যে কাণ্ড হয়েছিল, একইভাবে মিলাররা এবার চিনির কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। যদিও মিলারদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামেই মিলগেট থেকে চিনি বিক্রি করছেন তাঁরা। ঈদ ঘিরে বাজারে পর্যাপ্ত চিনি সরবরাহ করা হয়েছে। সংকটের সুযোগ নেই।
সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের মাহিন জেনারেল স্টোরের বিক্রয়কর্মী মো. সুমন বলেন, ‘মৌলভীবাজারে চিনির দাম বাড়তি। ৫ হাজার ৫০০ টাকা বস্তা চিনি সপ্তাহ ব্যবধানে ৬ হাজার টাকার কাছাকাছি দামে কিনতে হচ্ছে। আগের কেনা এক বস্তা ছিল, দেড় ঘণ্টায় বিক্রি শেষ।’ কারওয়ান বাজারের রতন স্টোরের স্বত্বাধিকারী
রতন হোসেন বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই কোম্পানিগুলো চিনি কম দিচ্ছে। দিলেও চিনির সঙ্গে বিরিয়ানি মসলা বা অন্যান্য পণ্য কেনার শর্ত দিচ্ছে। ডিলাররা চিনি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। সপ্তাহখানেক তো চিনি দিচ্ছেই না। দু-এক বস্তা দিলেও দাম নিচ্ছে প্রায় ৬ হাজার টাকা। শ্রমিক খরচ যোগ করলে খুচরা পর্যায়ে ১২৫-১৩০ টাকার কমে বিক্রি করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘লুকিয়ে চিনি বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ ডিলাররা প্যাকেটের গায়ের চেয়ে বেশি দাম নিচ্ছেন। প্রতি কেজির প্যাকেট ১১৫-১১৭ টাকা নিলেও বিক্রয় রসিদ দিচ্ছেন না। ফলে আমাদের বিপদে পড়তে হচ্ছে।’
অবশ্য দাম বেশির জন্য পাইকাররা দুষলেন আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীদের। তাঁদের অভিযোগ, আমদানি শুল্ক কমানের পর সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, আমদানিকারকরা তা মানছেন না। তাঁরা কৌশলে চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন।
সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে দেখা গেছে, গত এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৪৯ শতাংশ। অবশ্য এ সময়ে বিশ্ববাজারেও দাম কিছুটা বাড়তি। আন্তর্জাতিক চিনি সংগঠন আইএসওর তথ্যমতে, বর্তমানে প্রতি টন চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৬১ ডলারে, যা সপ্তাহ দুয়েক আগেও ছিল ৬২৮।
বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাশেম বলেন, ‘মিলাররা কেউই সরকার নির্ধারিত দরে চিনি দিচ্ছেন না। এতদিন বাড়তি দামে পাওয়া গেলেও কয়েক দিন ধরে একেবারেই দিচ্ছেন না। শুধু মেঘনা গ্রুপ কিছু দিচ্ছে। সিটি গ্রুপের মিলে মাসের পর মাস ঘুরেও চিনি মিলছে না।’ তবে পাইকারি বাজারে খুব বেশি দাম বাড়েনি দাবি করে তিনি বলেন, ‘পাইকারিতে এখন প্রতি বস্তা ৫ হাজারের কিছু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।’
ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে আমদানিকারকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট চারবার চিনির দাম বাড়ানো হয়। ফলে ৮৪ টাকা কেজির খোলা চিনি বেড়ে হয় ১০৭ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনির কেজি দাঁড়ায় ১১২ টাকা। তবে বাজারের অস্থিরতা না কাটলে আমদানিকারকদের অনুরোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এনবিআরের মাধ্যমে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ থেকে ২৫ শতাংশ করে। একই সঙ্গে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৩ হাজার এবং পরিশোধিত চিনিতে ৬ হাজার টাকা আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে। শুল্ক ছাড়ের এ সুবিধা আগামী ৩০ মে পর্যন্ত পাবেন আমদানিকারকরা।
আমদানিকারক ও বাজারজাতকারীদের তথ্যমতে, শুল্ক ছাড়ের পর চিনি আমদানি হলে কেজিতে ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকা পর্যন্ত দাম কমার কথা। তবে গত বৃহস্পতিবার কেজিতে ৩ টাকা কমিয়ে নতুন দর ঘোষণা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত শনিবার থেকে খোলা চিনি ১০৪ এবং প্যাকেটজাত ১০৯ টাকায় বিক্রি করার কথা। কিন্তু রাজধানীর কোথাও এ দরে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক এস এম মুজিবুর রহমান বলেন, ‘মিল থেকে সরকার নির্ধারিত ১০৯ টাকা দরেই চিনি দেওয়া হচ্ছে। ডিলাররা কমিশনও পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা ১০৯ টাকার বেশি নিলে সেটি অন্যায়। আমরা বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্যাকেট চিনির চেয়ে খোলা চিনির চাহিদা বেশি। ঈদে চিনির চাহিদা অনেকটা বেড়ে যায়। এর পরও আশা করছি, সরবরাহে ঘাটতি হবে না।’
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, ‘বিশ্ববাজারে প্রতি টন চিনি ৭০০ ডলারের কাছাকাছি। গরম ও ঈদ উপলক্ষে চিনির চাহিদা বেড়েছে। কিছু ব্যবসায়ী হয়তো এ সুযোগটা নিচ্ছেন।’