অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সংক্রমণের চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যান ২৮ বছর বয়সী এক নারী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেশ কিছুদিন তাঁর ড্রেসিং (ক্ষতস্থান পরিষ্কার) করেন হাসপাতালের কর্মী রিয়াজ উদ্দিন রবিন। এক দিন তিনি বলেন, ‘তোমার কিছু গোপন ছবি আছে আমার ফোনে।’ ছবিগুলো দেখিয়ে তিনি হুমকি দেন, তাঁর সঙ্গে একান্তে সময় না কাটালে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ওই নারী সম্ভাব্য বিপর্যয়ের আশঙ্কায় তাঁকে ‘ভাই’ ডেকে অনেক কাকুতি-মিনতি করেন। তবে শেষ পর্যন্ত ফাঁদে পড়ে সামাজিক বদনামের ভয়ে ওই অনৈতিক প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হন তিনি। সেসব মুহূর্তের ছবিও কৌশলে তুলে রাখেন রবিন।
এর পর ছবি-ভিডিও ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে বারবার তাঁর ওপর চলে যৌন নিপীড়ন। এক পর্যায়ে তিনি পুলিশের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন রবিন বিদেশে চলে যান। তবে পরে তিনি ওই নারীর স্বামীর কাছে ছবিগুলো পাঠিয়ে দেন। এতে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন ভুক্তভোগী নারী।
কিছুদিন পর ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ছবিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে ওই নারীর জীবন চরম দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তিনি ভুয়া আইডি বন্ধ ও ছবি অপসারণের জন্য আদালতে মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে– রবিন নন, ছবিগুলো ছড়িয়েছেন ভুক্তভোগীর জায়ের (স্বামীর ভাইয়ের স্ত্রী) ভাই। শেষ পর্যন্ত অপরাধী শনাক্ত হলেও ওই নারীর জীবনে ওঠা ঝড় আর থামছে না। লোকজনের নির্দয় কটূক্তির কারণে তিনি এখন ঘর থেকে বের হতে পারেন না। ঘরে মারধর আর গালাগাল তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী।
জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভুক্তভোগী নারী বলেন, ‘সবাই আমারে খারাপ মেয়ে বলতেছে। স্বামী আমার সঙ্গে সংসার করতে চায় না। প্রত্যেক দিন ঝগড়াঝাঁটি হয়, মারধর করে। ওই ছবিগুলা দেইখা সে (স্বামী) নিজেও অসুস্থ হয়া পড়ছে। কিন্তু আমার কী অপরাধ? ওরা দুইজন আমার জীবনটা ধ্বংস কইরা দিল।’
ওই নারী স্বামী-সন্তানের সঙ্গে থাকেন রাজধানীর কড়াইল এলাকার ভাড়া বাসায়। ২০১৯ সালে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে তাঁর তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়। এর পর সেলাইয়ের স্থানে দেখা দেয় সংক্রমণ। সেটির চিকিৎসা চলমান থাকতেই ২০২০ সালে তাঁর অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়। সেখানেও সংক্রমণ দেখা দেয়। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসায় সেরে না ওঠায় ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ডা. নিবেদিতার অধীনে তাঁর চিকিৎসা চলে। ওই সময় কর্তব্যরত নার্সরা ওয়ার্ডবয় রিয়াজ উদ্দিন রবিনকে ড্রেসিংয়ের দায়িত্ব দেন। তিনি নিয়মিত ড্রেসিং করে দেন, বিনিময়ে অর্থ নেন। একদিন রবিন ভুক্তভোগী নারীকে জানান– হাসপাতালে অনেক ভিড়, তা ছাড়া প্রতিদিন এভাবে ড্রেসিং করা যাবে না। বিকল্প পথও তিনিই বাতলান। হাসপাতালের পাশের এলাকার একটি বাসায় ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে ড্রেসিং করতে হবে। তত দিনে রবিনের ওপর আস্থা গড়ে ওঠায় নারী এ প্রস্তাবে রাজি হন।
এর পর রবিন অনলাইনে ছবি ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে তাঁকে একান্তে সময় কাটাতে বাধ্য করেন। এভাবে তাঁকে জিম্মি করে চালানো হয় যৌন নিপীড়ন। সেই সঙ্গে রবিনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিও তুলতে বাধ্য করেন। বিদেশে যাওয়ার পরও ফোনে নিয়মিত কথা বলতেন রবিন। একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে ছবিগুলো পাঠিয়ে দেন ওই নারীর স্বামীর মোবাইল ফোনে। রবিনের কাছ থেকে তাঁর চার বন্ধুও ছবিগুলো পেয়েছেন। তাঁরাও ফোন করে নানাভাবে নারীকে উত্ত্যক্ত করছেন।
এ ঘটনায় সাইবার ট্রাইব্যুনালে করা মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই ঢাকা মহানগর দক্ষিণের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এসআইঅ্যান্ডও) সাগর সরকার বলেন, বাদীর ধারণা ছিল– রবিন বা তাঁর বন্ধুরা ছবিগুলো ফেসবুকে ছড়িয়েছেন। তবে তদন্তে জানা যায়, তাঁর এক আত্মীয় এতে জড়িত। অপকর্মে ব্যবহৃত ওই ব্যক্তির মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। তিনি অপরাধ স্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, তাঁর বোনের সংসারে অশান্তির নেপথ্যে রয়েছেন ভুক্তভোগী নারী। এ কারণে তাঁকে ‘শিক্ষা’ দিতে তিনি এই পথ বেছে নেন। অবশ্য দুই জায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি ওই নারীর।