চিকিৎসকদের কর্মবিরতি স্থগিত করা হয়েছে। সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত এ কর্মবিরতি স্থগিত করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে বৈঠকের পর এ ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানের কক্ষে বসা এ বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহও ছিলেন।
বৈঠকে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এ ঘোষণা দেওয়ার পরই ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় চারজনের নাম উল্লেখ করে ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিইউবিটির শিক্ষকসহ তিন শিক্ষার্থী রয়েছেন।
রোববার (১ সেপ্টেম্বর) শাহবাগ থানায় এই মামলা করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর ঘটনায় শনিবার (৩১ আগস্ট) রাত সাড়ে ৮টায় রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের মারধর করে।
অভিযোগ ওঠে, রোগীর স্বজনরা ওটিতে ঢুকে ডা. ইমরান ও ডা. মাশরাফিকে মারধর করেছে।
স্বজনদের দাবি, চিকিৎসকদের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারদের দাবি, রোগী পথেই মারা গেছেন।
শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় দিকে দুর্ঘটনায় পতিত এ রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।
তখন থেকেই নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ তুলে ঢামেকের জরুরি বিভাগের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা।
পরে সকালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত, দোষীদের গ্রেপ্তার ও সেনাবাহিনী মোতায়েন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য সারাদেশে সব চিকিৎসাকেন্দ্রে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি ঘোষণা করে।
চিকিৎসকদের কর্মবিরতি চলায় বিপাকে পড়েন শত শত রোগী ও তাদের স্বজনরা। অনেকেই কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফিরে যাচ্ছেন। আবার কিছু রোগী ও তাদের স্বজনদেরকে জরুরী বিভাগের সামনে যন্ত্রণা আর হতাশায় শুয়ে পড়তেও দেখা গেছে।
চিকিৎসা সেবা না পেয়ে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। অ্যাম্বুলেন্সে করে জরুরি চিকিৎসার জন্য আনা রোগীদের নিয়ে কী করবেন, কোথায় যাবেন- বুঝতে পারছেন না তাদের স্বজনরা। সেবা না পেয়ে আহাজারিও করতেও দেখা গেছে অনেককে।
এদিকে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরে ধারালো অস্ত্র নিয়ে দুই পক্ষের হামলার ঘটনায় চাপাতিসহ চারজনকে রাতেই আটক করেছে সেনাবাহিনী।
আটক হওয়া চারজন হলেন, বাপি মিয়া (২৪), আদিব (২৩) নাসির (২৫) নাবিল (২৭)। তারা সবাই খিলগাঁও থানার বাসিন্দা।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগ এলাকায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষের একটি ঘটনা ঘটে। পরে এই ঘটনায় আহত এক গ্রুপ ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসে। পরে অন্য আরেকটি গ্রুপ চাপাতি নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরে ঢুকে যায়। এ সময় চারজনকে আটক করে সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হয়।
অপরদিকে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (ঢামেক) নিউরো সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন আব্দুল আহাদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, চেম্বার ও চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলবে। এই সময়ে কোনো সেবা দেওয়া হবে না।
চিকিৎসকদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- হাসপাতালের মতো একটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যেসব ব্যক্তি বা কুচক্রী মহল ন্যক্কারজনক এই হামলার সঙ্গে জড়িত, তাদের সবাইকে চিহ্নিত করে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।
নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে অবিলম্বে দেশের সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য পুলিশের (আর্মড ফোর্স) মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে হাসপাতালে রোগীর ভিজিটর (ভিজিটর কার্ডধারী) ব্যতীত বহিরাগত ব্যক্তি বা মহল কোনোভাবেই হাসপাতালের ভেতর প্রবেশ করতে পারবে না, যা স্বাস্থ্য পুলিশের (আর্মড ফোর্স) মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
হাসপাতালে রোগীর সেবাপ্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অসংগতি বা অবহেলা পরিলক্ষিত হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ প্রদানের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে। তবে, কোনোভাবেই আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।
এ অবস্থায় ডাক্তারদের কর্মবিরতি কর্মসূচি উঠিয়ে নেওয়ারও আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেছেন, চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে চিকিৎসকদেরও উচিত কর্মবিরতি কর্মসূচি উঠিয়ে নেওয়া।
তিনি বলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহসানুল হক দীপ্ত নামে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির (বিইউবিটি) এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এটা ঠিক হয়নি।
রোববার (১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা খুবই পীড়াদায়ক। ডাক্তাররা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বড় আঘাত হওয়ায় বাঁচানো যায়নি। গাফিলতি হলে সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা না শুনে ডাক্তারদের ওপর হাত তোলা হয়েছে, এটা ঠিক হয়নি।
নূরজাহান বেগম বলেন, ঢাকা মেডিকেলের পর আরও দুটি জায়গায় এমন ঘটনা ঘটেছে, যা খুবই দুঃখজনক। ডাক্তাররা তাদের যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করেছে। এভাবে কথায় কথায় ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলা যাবে না।
পরে চিকিৎসকদের উদ্দেশে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলনরত ডাক্তাররা আমাদের সন্তানের মতো। তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাবো, ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি তুলে নাও। মানুষের সেবায় এসেছ, মানুষের সেবায় ফিরে যাও।