সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা চাঁদে অভিযানের জন্য নতুন ১০ নভোচারীর নাম ঘোষণা করেছে। এই ১০ জনের মধ্যে থেকেই কেউ হয়তো ভবিষ্যতে মঙ্গলের লাল মাটিতে প্রথম পা রাখবেন। অথবা চাঁদে তৈরি হওয়া মানুষের নতুন ঘাঁটিতে তাঁরাই হতে পারেন প্রথম বাসিন্দা। এই নতুন দলটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২০২১ সালের পর এটিই নাসার নতুন নভোচারী দল।
যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে ২২ সেপ্টেম্বর, সোমবার এক জমকালো অনুষ্ঠানে এই নতুন নভোচারীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। আট হাজারের বেশি আবেদনকারীর মধ্য থেকে যাচাই-বাঁচাই করে পাঁচজন পুরুষ এবং পাঁচজন নারীকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
নাসার ফ্লাইট অপারেশন ডিরেক্টর নর্ম নাইট বলেন, ‘এ নির্বাচন প্রক্রিয়াটি ছিল খুবই প্রতিযোগিতামূলক ও কঠিন। কিন্তু আজ আমরা এমন একদল মানুষকে আপনাদের সামনে এনেছি, যারা শুধু ব্যতিক্রমীই নন, তাঁরা আমেরিকা এবং আমাদের এই গ্রহের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবেন।’
এই ১০ জন প্রার্থী এখন দুই বছরের কঠোর প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে ফিরে গিয়ে তাঁরা মহাকাশ যাত্রা, স্পেসওয়াক বা মহাশূন্যে হাঁটা, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মহাকাশে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেবেন। প্রায় দুই বছর পর গ্র্যাজুয়েট হবেন তাঁরা।
নাসা যখন আর্টেমিস-৩ মিশনের মাধ্যমে আবার চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন এই নতুন দলটি হয়তো সেই মিশনের জন্য কিছুটা অনভিজ্ঞ থাকবে। কিন্তু আর্টেমিস প্রোগ্রামের পরবর্তী মিশনগুলোতে তাঁরাই হবেন মূল ভরসা। চাঁদে একটি স্থায়ী বেস তৈরি করা এবং সেখান থেকে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর যে বিশাল পরিকল্পনা নাসার রয়েছে, এই নভোচারীরাই তা বাস্তবায়ন করবেন।
শুধু চাঁদ বা মঙ্গলই নয়, তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও এক নতুন জগৎ। ২০৩০ সালের পর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন অবসর নেবে। এরপর ব্লু অরিজিন, অ্যাক্সিওম স্পেসের মতো বেসরকারি সংস্থাগুলো নিজেদের মহাকাশ স্টেশন তৈরি করবে। এই নতুন নভোচারীরাই হয়তো প্রথম নাসার হয়ে কোনো বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশনে থাকবেন এবং গবেষণা চালাবেন।
নতুন এই দশ নভোচারী সম্পর্কে এবার জানা যাক।

বেন বেইলি
৩৮ বছর বয়সী বেন বেইলি মার্কিন সেনাবাহিনীর চিফ ওয়ারেন্ট অফিসার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক। ইউএস নেভাল টেস্ট পাইলট স্কুলের এই গ্র্যাজুয়েট ৩০টিরও বেশি ভিন্ন ধরনের বিমানে ২ হাজার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উড়েছেন।

লরেন এ. এডগার
৪০ বছর বয়সী লরেন একজন ভূতত্ত্ববিদ। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। গত ১৭ বছর ধরে তিনি নাসার মঙ্গল গ্রহের রোভার মিশনের সঙ্গে কাজ করছেন এবং আর্টেমিস-৩ মিশনের ভূতত্ত্ব দলের ডেপুটি প্রধান তদন্তকারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

অ্যাডাম ফুরম্যান
৩৫ বছর বয়সী অ্যাডাম ফুরম্যান মার্কিন বিমান বাহিনীর একজন মেজর। তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক। ২৭টি ভিন্ন ধরনের বিমানে ২ হাজার ১০০ ঘণ্টা উড়েছেন তিনি। এর মধ্যে ৪০০ ঘণ্টা যুদ্ধকালীন সময়ের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর।

ক্যামেরন জোন্স
ক্যামেরন জোন্সও মার্কিন বিমান বাহিনীর একজন মেজর এবং টেস্ট পাইলট। তাঁর বয়স ৩৫। তিনি ৩০টিরও বেশি ভিন্ন বিমানে ১ হাজার ৬০০ ঘণ্টার বেশি উড়েছেন। এর মধ্যে ১৫০ ঘণ্টা কাটিয়েছেন যুদ্ধকালীন সময়ে।

ইউরি কুবো
৪০ বছর বয়সী ইউরি কুবো যুক্তরাষ্ট্রের পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেছেন। তিনি স্পেসএক্স-এ ১২ বছর ধরে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। এর মধ্যে ফ্যালকন-৯ রকেটের লঞ্চ ডিরেক্টরের দায়িত্বও ছিল। সম্প্রতি তিনি কুবো ইলেকট্রিক হাইড্রোজেন কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন।

রেবেকা ললার
৩৮ বছর বয়সী রেবেকা টেক্সাসের লিটল এলমের বাসিন্দা। তিনি মার্কিন নৌবাহিনীর একজন প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। তিনি ৪৫টিরও বেশি ধরনের বিমানে ২ হাজার ৮০০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের হয়ে ‘হারিকেন হান্টার’ হিসেবেও বিমান চালিয়েছেন রেবেকা।

অ্যানা মেনন
৩৯ বছর বয়সী অ্যানা মেনন ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেছেন। তিনি ইতিমধ্যেই একবার মহাকাশে গিয়েছেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে স্পেসএক্সের পোলারিস ডন মিশনে তিনি মহাকাশে যান এবং প্রথম বেসরকারি স্পেসওয়াকের অংশ হন।

ইমেল্ডা মুলার
৩৪ বছর বয়সী ইমেল্ডা মার্কিন নৌবাহিনীর একজন প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট এবং একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। তিনি নিউইয়র্কের কোপাকে ফলসের বাসিন্দা। জনসন স্পেস সেন্টারে নৌবাহিনীর ডুবুরি প্রশিক্ষণে চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছেন তিনি।

এরিন ওভারক্যাশ
৩৪ বছর বয়সী এরিন মার্কিন নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এবং টেস্ট পাইলট। তিনি ২০টি ভিন্ন বিমানে ১ হাজার ৩০০ ঘণ্টার বেশি উড়েছেন এবং ২৪৯ বার বিমানবাহী রণতরীতে বিমান অবতরণ করিয়েছেন। রাগবিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দলের সঙ্গেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি।

ক্যাথরিন স্পাইস
৪৩ বছর বয়সী ক্যাথরিন একজন প্রাক্তন মার্কিন মেরিন কর্পস অ্যাটাক হেলিকপ্টার পাইলট। তিনি ৩০টিরও বেশি ধরনের বিমানে ২ হাজার ঘণ্টার বেশি উড়েছেন। সম্প্রতি তিনি গালফস্ট্রিম অ্যারোস্পেস কর্পোরেশনে ফ্লাইট টেস্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছিলেন।
নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি এই নতুন দল নিয়ে দারুণ আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘তোমরা আমেরিকার সেরা ও মেধাবী মানুষ। আর আমাদের এই সেরাদেরই প্রয়োজন হবে। কারণ, আমরা আবার চাঁদে ফিরে যাচ্ছি। এবার আমরা সেখানে থাকব এবং চাঁদের মিশন থেকে যা শিখব, তা নিয়ে মঙ্গলে যাব। আর এভাবে আরও অজানার দিকে যেতেই থাকব।’
তবে এই যাত্রায় প্রতিযোগিতাও রয়েছে। শন ডাফির কথায় স্পষ্ট হয়েছে যে এটা শুধু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান নয়, গর্বের বিষয়ও। চীনের মহাকাশ কর্মসূচি দ্রুত এগিয়ে চলেছে এবং তারাও চাঁদে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এই প্রতিযোগিতা হয়তো একদিকে উৎকণ্ঠার, কিন্তু অন্যদিকে এটা মানুষের মহাকাশ অভিযানকে আরও গতিশীল করবে। আর সে প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার হবেন এই দশজন। যাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সেরা। তাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান আর সাহস একসঙ্গে মিলে তৈরি করবে মহাকাশ অভিযানের নতুন ইতিহাস।
সূত্র: স্পেস ডটকম
কাজী আকাশ