চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ বছরে ছাত্রলীগের ১৯০ জন বহিষ্কার

0
220
লাঠিসোঁটা হাতে সংঘর্ষে জড়ান ছাত্রলীগের উপপক্ষ ‘বিজয়’–এর নেতা–কর্মীরা

ছাত্রলীগের কোন্দল ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে পক্ষ থেকে মহিবুল হাসান চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীনের কাছে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও ক্যাম্পাসে থাকছেন। বছরের পর বছর তাঁরা ক্যাম্পাসের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। তাঁদের ক্যাম্পাস থেকে বের করার উদ্যোগ নিতে প্রশাসনকে অনুরোধ করা হয়েছে। এঁরা বের হয়ে গেলে সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। তাঁর দাবি, ক্যাম্পাসে তাঁর কোনো অনুসারী নেই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোনো বিরোধ নিয়ে আবার সংঘর্ষে ছাত্রলীগ

একুশের প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের কক্ষ দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ান ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা

একুশের প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের কক্ষ দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ান ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা 

অপর দিকে ছাত্রলীগের ‘অপরাধমূলক’ কর্মকাণ্ড দমনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব আছে বলে মনে করেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি বলেন, এখন রাজনীতির নামে অপরাজনীতি হচ্ছে। এগুলো কোনো অবস্থায়ই কাম্য হতে পারে না। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সব সময় কঠোর হাতে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশাসন কোনো অবস্থাতেই কঠোর হয় না।

এখনো খোলা হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদ

নিজেরাই এখন নিজেদের প্রতিপক্ষ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ছাত্রশিবিরের আধিপত্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতারা জানান, গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর হয় ছাত্রশিবির। একসময় পুরো ক্যাম্পাসই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করে। এ নিয়ে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তাদের প্রায়ই সংঘর্ষ হতো।

২০০৯ সালে আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। ২০১৪ সালের দিকে ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্য কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদলও ক্যাম্পাসে টিকতে পারেনি। ফলে ছাত্রলীগের এখন তেমন কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই। নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়াচ্ছে।

সাবেক ছাত্রনেতারা আরও জানান, ছাত্রলীগের মধ্যে বিভিন্ন উপদল গড়ে ওঠা শুরু হয় আশির দশকে। শহর থেকে ক্যাম্পাসে যেতে যে শাটল ট্রেন রয়েছে, সেই ট্রেনের বগিভিত্তিক ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপদল গড়ে ওঠে। এখন সেই উপদলগুলোর বিভেদ চরমে পৌঁছেছে। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলেও বিভক্তি দূর হয়নি।

ক্যাম্পাসে গত ১৪ বছরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে কতবার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন, কতবার ভাঙচুর করেছেন, এর প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই ১৪ বছরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৫০ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন।

অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ ‘ভার্সিটি এক্সপ্রেস’ ও ‘চুজ ফ্রেন্ড উইথ কেয়ারের’ (সিএফসি) নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়ান। এ সময় গুলিতে তাপস সরকার নামের এক শিক্ষার্থী মারা যান। উল্লেখ্য, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ক্যাম্পাসে পাঁচটি খুনের ঘটনা ঘটে, যার একটিরও বিচার শেষ হয়নি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন ছাত্রলীগের, দুজন ছাত্রশিবিরের এবং একজন সাধারণ শিক্ষার্থী।

কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লেখালেখির কারণে গত পাঁচ বছরে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে মারধর করার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

অপরাধে তাঁরা

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, চুরি এবং ছাত্রী নিপীড়ন ও হেনস্তার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি শিক্ষককে হুমকি দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে।

২০২১ সালের জুন মাসে চাঁদা না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ বন্ধ করে দেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ওই অনুষদের তৎকালীন ডিন এস এম সালামত উল্যা ভূঁইয়া।

২০২২ সালের ১৭ জুলাই রাতে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হন। ওই ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করা হয়। এ ঘটনায় পাঁচ তরুণের নাম আসে, যাঁদের দুজন ছাত্রলীগের কর্মী। ওই পাঁচজন এখন কারাগারে।

ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে তাঁরা কর্তৃপক্ষকে চাপ দেন। গত ৩০ জানুয়ারি ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতাকে শিক্ষক পদে নিয়োগ না দেওয়ায় উপাচার্যের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর দায় চাপিয়েছেন। তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের গাফিলতি রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য শিরীণ আখতার কথা বলতে রাজি হননি। তবে কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি নেই বলে দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য বেনু কুমার দে। অন্যদিকে সহকারী প্রক্টর শহীদুল ইসলাম বলেছেন, এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরও কঠোর হবে।

বহিষ্কার নামে

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১৪ বছরে ছাত্রলীগের অন্তত ১৯০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে অন্তত ১০ জনকে। সর্বশেষ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, সংবাদকর্মীকে হেনস্তা ও প্রাধ্যক্ষকে হুমকির ঘটনায় গত জানুয়ারিতে ১৭ জনকে বহিষ্কার করা হয়।

বহিষ্কৃত হওয়ার পরও নেতা-কর্মীদের দাপট কমেনি। তাঁরা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ান। হলে থাকেন। এমনকি সংঘর্ষেও জড়ান। কিন্তু প্রশাসন নিরব থাকে। গত জানুয়ারিতে বহিষ্কৃত চারজন নেতা-কর্মী নিজ নিজ বিভাগ ও বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।

চট্টগ্রামের প্রবীণ শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান বলেন, ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা যে ছাত্র, তাঁরা হয়তো সেটা ভুলে গেছে। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যোগ দিয়ে তাঁরা নিজেদের অধিক ক্ষমতাবান মনে করছেন। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও অপরাধপ্রবণতা রোধে কার্যকর ভূমিকা নিতে সক্ষম হচ্ছে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.