ডলার–সংকটে জ্বালানি আমদানি ব্যাহত। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১৮ শতাংশ অব্যবহৃত জ্বালানির অভাবে।
তাপপ্রবাহের কারণে দেশে গরম বেড়েছে। বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদাও। কিন্তু পর্যাপ্ত উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি নেই। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশ অলস বসে থাকছে; বাড়ছে লোডশেডিং।
বিদ্যুতের ঘাটতি বাড়লে সাধারণত গ্রামে বেশি লোডশেডিং করা হয়। তবে এখন রাজধানীতে লোডশেডিং করা হচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা জানান, গতকাল মঙ্গলবার কয়েক দফা করে লোডশেডিং হয়েছে।
দেশে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৩। গত সোমবারের হিসাবে, ওই দিন অন্তত ৫২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে ছিল। কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে ছিল কয়লা, গ্যাস অথবা জ্বালানি তেলের অভাবে। রক্ষণাবেক্ষণসহ বেশ কিছু কারণে বন্ধ ছিল কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটা প্রায়ই হয়ে থাকে বলে জানান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দুজন কর্মকর্তা। তাঁরা বলেন, উৎপাদন বন্ধ থাকলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হয়। পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রভাড়া দিতে হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। পিডিবির তথ্য বলছে, এর মধ্যে ২৪ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ৪ হাজার ২৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার করা যায়নি জ্বালানির অভাবে, যা মোট উৎপাদন ক্ষমতার ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। বাকি ১৭ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা ব্যবহার করে দিনের বেলায় গড়ে উৎপাদন করা হয়েছে ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। রাতে উৎপাদিত হয়েছে গড়ে ১৩ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট।
দেশে মার্কিন ডলারের সংকটে সরকার গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে চাপে রয়েছে। এ কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রয়োজন অনুযায়ী জ্বালানি দেওয়া যাচ্ছে না।
মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক। কয়েক দিন ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। দৈনিক ১১০ থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস পাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। কিন্তু গ্যাসভিত্তিক সব কেন্দ্র চালানোর মতো গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। পিডিবির হিসাবে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ৩৯ মেগাওয়াট। গড়ে উৎপাদন করা হয়েছে ৬ হাজার ২২১ মেগাওয়াট।
ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। যদিও কয়েক দিনে গড়ে উৎপাদন করা হয়েছে দৈনিক ৩ হাজার ৮০৬ মেগাওয়াট। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। উৎপাদন করা হচ্ছে ২ হাজার ২২৬ মেগাওয়াট।
ডলারের অভাবে বিল বকেয়া পড়ায় কয়েক মাস ধরে কয়লা কিনতে পারেনি সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘পায়রা’। মজুত কয়লা শেষ হয়ে এসেছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এ কেন্দ্রে। একটি ইউনিট ২৫ মে বন্ধ করা হয়েছে। আরেকটি ইউনিট থেকে প্রতিদিনই উৎপাদন কমছে। এই ইউনিট অন্তত তিন সপ্তাহের জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহে।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী গতকাল বলেন, গ্যাস সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। জ্বালানি তেলের সরবরাহও আছে। চাহিদামতো উৎপাদনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু ঘাটতি থাকতে পারে।
গরমে চাহিদা বেড়েছে
বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা কম থাকায় ১৭ মে থেকে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়। দিনে ১০ হাজার মেগাওয়াটের কম উৎপাদন করেই ভোক্তার চাহিদা মেটানো গেছে। তাই তেমন কোনো লোডশেডিং করতে হয়নি। তবে তাপমাত্রা বাড়তেই লোডশেডিং শুরু হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার জন্য দেওয়া পূর্বাভাসে বলেছে, সারা দেশে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকতে পারে। আর এ কারণে দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এতে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে, গত সোমবার সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে রাত ১২টায় ১ হাজার ৭২৬ মেগাওয়াট। আর গতকাল দিনের বেলায় সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে সকাল ১০টায় ১ হাজার ৫০৬ মেগাওয়াট। রাতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। এতে ঘাটতি আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছিলেন কর্মকর্তারা।
গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দেশের ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার তথ্য বলছে, দিনে লোডশেডিং দুই হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সোমবার লোডশেডিং করেছে ৮৬৬ মেগাওয়াট। গতকাল লোডশেডিং ১ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়েছে খুলনা, রাজশাহী ও ময়মনসিংহের গ্রাম এলাকায়।
ঢাকা শহরে গতকাল গড়ে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করেছে দুই বিতরণ সংস্থা—ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। গতকাল বিকেল চারটায় দুটি সংস্থার বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। তারা চাহিদার চেয়ে ৪৫০ মেগাওয়াট কম পেয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে লোডশেডিং করে।
তবু লোডশেডিং
বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। এখন সেটা ২৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাদে)। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়ে লোডশেডিংয়ের দুঃসহ পরিস্থিতি দূর করতে পেরেছে। কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, ভাড়াভিত্তিক বা রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো, বসিয়ে বসিয়ে কেন্দ্রভাড়া দেওয়া এবং বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, গত ১৫ বছরে ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে এ বছরের প্রথম তিন মাসে বাড়ানো হয় তিনবার, প্রতিবার ৫ শতাংশ করে। তারপরও লোডশেডিংয়ে মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। ওদিকে বসে বসে কেন্দ্রভাড়া পাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র।
ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, উৎপাদন করতে না পারলেও সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েই যাচ্ছে। কোনো যথাযথ পরিকল্পনা নেই। সামনে লোডশেডিং আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।