‘ভিলেজ পাজেরো’ নামে ইঞ্জিনচালিত একটি গাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রান্তিক জনপদ গুরুদাসপুরের অলিতে-গলিতে। আধুনিক সময়ে যান্ত্রিক শহরের নানা ধরনের গাড়ি দেখে অভ্যস্থ থাকলেও গুরুদাসপুরের ওয়ার্কশপ মেকানিকের তৈরি গাড়িটি দেখতে আগ্রহী পথচারীরা। গ্যারেজের বাতিল যন্ত্রাংশ ও মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন দিয়ে ছোট জিপ গাড়ির আদলে এই গাড়ি বানিয়েছেন ওয়ার্কশপ মেকানিক মো. রাজিব হোসেন (৩০)। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া মেকানিক রাজিব নিজের তৈরি গাড়িতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায়।
রাজিব হোসেন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের মো. নিজামুদ্দিন হোসেনের ছেলে। তার বানানো গাড়িটি দেখতে ও ঘুরে বেড়াতে প্রতিদিন ওয়ার্কশপের দোকানে ভিড় জমায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
বিয়াঘাট ইউনিয়নের রাবারড্যাম বাজারে রাজিবের একটি গ্যারেজ আছে। দুই সন্তানের জনক রাজিব হোসেন জন্মগ্রহণ করেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারে। এরপর সংসারের অভাব-অনটনের কারণে পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করা হয়নি। তবে স্থানীয় হাফেজিয়া মাদ্রাসা থেকে ৩০ পাড়া কোরআন মুখস্ত করেছেন।

২০১৩ সালে রাবারড্যাম বাজারে একটি ওয়ার্কশপের গ্যারেজ করেন রাজিব। সেখানে বিভিন্ন গাড়ি মেরামত শুরু করেন। রাজিবের ছোট বেলার একটি শখ ছিল চার চাকার গাড়িতে উঠার। সেই শখ থেকেই ২০১৮ সালে জিপ গাড়ির আদলে গ্যারেজের বাতিল যন্ত্রাংশ দিয়ে ছোট একটি গাড়ি বানানোর কাজ শুরু করেন।
২০২৩ সালে এসে সেই গাড়িটি চলাচলের জন্য উপযোগী হয়। গ্যারেজের বাতিল যন্ত্রাংশ ও মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন দিয়ে এই গাড়িটি তৈরি করেছেন তিনি। গাড়িটির নাম দিয়েছেন ‘ভিলেজ পাজেরো’।
গ্রামে বসবাস ও গ্রামের রাস্তা দিয়ে এই গাড়ি নিয়ে বেশি সময় চলাচল করার কারণেই এমন নাম দিয়েছেন তিনি।
গাড়িটির সামনে চালকের পাশে একজন ও পেছনে দুইজন বসতে পারেন। তবে রাজিবের বানানো গাড়িটির কাজ এখনও চলমান। রাজিবের ইচ্ছে আছে গাড়ির ওপরে ছাউনি দিয়ে রঙ করার।
গাড়িটির পেছনে লেখা রয়েছে ‘আগে তেল দিন’। নিজের শখ পূরণে এই গাড়িতে উপজেলা, জেলা শহর ছাপিয়ে বিভাগীয় শহরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুরেছেন রাজিব। বিভিন্ন জায়গা থেকে এই গাড়ি দেখতে আসা মানুষজন ভাড়া নিতে চাইলেও রাজিব দেন না। ছবি তোলা কিংবা ভিডিও করার জন্য আশপাশ এলাকা দিয়ে ঘুরতে হলে গাড়িতে আগে তেল দিতে হবে। এজন্যই গাড়ির পেছনে লিখে রেখেছেন ‘আগে তেল দিন’।
রাজিব হোসেন বলেন, শৈশবকালে বাবার সঙ্গে নাটোর বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে এমন একটি গাড়ি দেখেছিলাম। গাড়িতে উঠার শখ ছিল কিন্তু সাধ্য ছিল না। তখন থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল একটি গাড়ি কেনার। কিন্তু আর্থিকভাবে আমি বা আমার পরিবার সচ্ছল না। গ্যারেজে কাজ করতে করতে হঠাৎ মনে হলো বাতিল যন্ত্রাংশ আর মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন দিয়ে একটি ছোট গাড়িও তো বানানো যায়। সেই থেকেই এই গাড়িটি বানানোর কাজ শুরু।
তিনি বলেন, ২০২৩ সালের শুরু থেকে এই গাড়িটি নিয়ে চলাচল করতে পারি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নাটোর, বগুড়া, রাজশাহী, ঈশ্বরদী ও বন্ধুদের নিয়ে কুষ্টিয়া, যশোর, সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত গিয়েছি এ গাড়ি চালিয়ে। আমার দোকানে অনেক মানুষ ভিড় করে গাড়িটি দেখতে। অনেকেই ভাড়া চায়। কিন্তু আমার ভাড়া দেওয়ার ইচ্ছা নেই।
‘শখের বসে কেউ ঘুরতে চাইলে তাকে আশপাশ এলাকায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। তবে সপ্তাহের শুক্রবার ফ্রি থাকি। শুক্রবারেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া হয়।’
তিনি আরও জানান, গাড়িটির কাজ এখনও বাকি আছে। ওপরে ছাউনি দিয়ে রঙ করার ইচ্ছে আছে। একটু আর্থিকভাবে সচ্ছল হলে গাড়িটি ঠিক করে নতুনের মতো করার চেষ্টা করব। এক লিটার পেট্রোলে আমার এই গাড়িতে ৩০ কিলোমিটার চালানো যায়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য শরিফুল ইসলাম বলেন, রাজিব অনেক মেধাবী ছেলে। অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়া করতে পারেনি। তার বানানো গাড়ি নিয়ে আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তিনি গাড়ির কোনো ভাড়া নেন না। তেল দিলেই রাজিব ফ্রি থাকলে ঘুরতে নিয়ে যায়। তবে আর্থিকভাবে রাজিবকে সহযোগিতা করা হলে তিনি আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারবেন।