রপ্তানিমুখী পোশাক চোর চক্রের মূল হোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৪। শুক্রবার রাতে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশেপাশের এলাকায় এ অভিযান চালানো হয়। র্যাব বলছে, দেড় যুগে দুই হাজারের বেশি চুরি করেছে শাহেদ। চুরির টাকায় সে কোটিপতি হয়েছে। মৌলভীবাজার শহরে তার ১৫-২০ কোটি টাকা দামের একটি বাড়ি আছে। জেলার দুর্লভপুরে প্রায় ২০ একর জমিতে রয়েছে মাছ চাষ প্রকল্পসহ বিশাল দুটি হাঁস-মুরগির খামার। এ ছাড়া তার চারটি ও সহযোগীদের আরও ১৫টি কাভার্ডভ্যান রয়েছে।
বহুল আলোচিত ব্রাজিলে রপ্তানি করা গার্মেন্ট পণ্য চুরিসহ বিপুল পরিমাণ পোশাক চুরিতে জড়িত চক্রটির চার সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাব। গ্রেপ্তার অপর তিনজন হলেন- গার্মেন্টের স্টক লট ব্যবসায়ী ইমারত হোসেন সজল, গাড়িচালক মো. শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ ও হেলপার মো. হৃদয়। অভিযানে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ব্রাজিলে রপ্তানির সময় চুরি করা পণ্য বহনে ব্যবহৃত একটি কাভার্ড ভ্যান।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গাজীপুরের কোনাবাড়ির একটি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গত বছরের ২৯ অক্টোবর ব্রাজিলে রপ্তানির উদ্দেশে একটি চালান পাঠায়। ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও দেখে হতবাক হয় কারখানার মালিকপক্ষ। ভিডিওতে দেখা যায়, কিছু কার্টন পুরোপুরি খালি এবং অনেক কার্টন থেকে প্রচুর পণ্য খোয়া গেছে। পরে চুরি হওয়া পণ্যের সমপরিমান অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় মালিকপক্ষকে। এ ঘটনায় গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় জিডি করা হয়। এরপর চুরির রহস্য উদঘাটন ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে কাজ শুরু করে র্যাব।
তিনি জানান, শাহেদ গার্মেন্ট পণ্য চুরি জগতের মাস্টারমাইন্ড এবং এই চক্রের প্রধান। তার ছত্রছায়ায় দেশের অধিকাংশ গার্মেন্ট পণ্য চুরি হয়। ৪০-৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে অসাধু গাড়িচালক, হেলপার, গুদাম মালিক, গুদাম এলাকার আশ্রয়দাতা, দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল শ্রমিক। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা গার্মেন্টের মালপত্র বহন শুরু করে। একপর্যায়ে পণ্য পরিবহনে সম্পৃক্ত কাভার্ড ভ্যানের চালক-হেলপারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। তাদের প্রলোভন দেখিয়ে দলে ভেড়ায়। প্রতিটি চুরির আগে তারা চালকদের মাধ্যমে রপ্তানি পণ্যের নমুনা নিয়ে সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করত। চোরাই পণ্যের দাম ১২-১৫ লাখ টাকা হলেই শুধু তারা চুরির সিদ্ধান্ত নিত। ব্রাজিলে রপ্তানির উদ্দেশ্যে পণ্য কাভার্ড ভ্যানে তোলার পর গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ গাড়িচালক শাহজাহানের কাছে নমুনা হিসেবে কিছু সোয়েটার দেয়। সে নমুনাগুলো পাওয়ার পরপরই ছবি তুলে শাহেদের কাছে পাঠায়। শাহেদ সেই ছবি তাওহীদুল ওরফে কাওছার ওরফে বড় কাওছারের কাছে পাঠায় এবং পণ্যের বাজারমূল্য বিবেচনা করে চুরির নির্দেশ দেয়। সে চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুরির পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাওছারের নির্দেশে চালক ও হেলপার ঘটনার দিন মধ্যরাতে ডেমরার মিরপাড়ার আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গুদামে ভ্যানটি পার্ক করে। তখন কুলি সর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে সহায়তাকারী মাসুম ওরফে মাসুদসহ অজ্ঞাতনামা ৫-৭ জন শ্রমিক নিয়ে কাওছার প্রতি কার্টন থেকে ৩০-৩৫ ভাগ পণ্য সরিয়ে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ড ভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়। এই চুরিতে জড়িত কাওছার, নাজিম ও মাসুমকে ২৪ ডিসেম্বর ডেমরা থেকে অপর একটি চুরির ঘটনায় গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪।
র্যাবের মুখপাত্র জানান, শাহেদ চট্টগ্রামে থাকাকালে ২০০৪ সালে চারটি কাভার্ড ভ্যান কিনে গার্মেন্ট পণ্য পরিবহন শুরু করে। তখন সে চালক-হেলপারদের প্রলোভন দেখিয়ে গার্মেন্ট পণ্য চুরির চক্র তৈরি করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সে নিজেই চুরি করত। এরপর সে পর্দার আড়ালে থেকে চুরির কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। প্রতিটি চুরির পণ্য বিক্রি করে পাওয়া অর্থের সর্বোচ্চ অংশ সে নিত। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্ট পণ্য চুরির মামলা রয়েছে।
তিনি জানান, গ্রেপ্তার ইমারত হোসেন সজল ২০১২ সালে উত্তরায় গার্মেন্ট পণ্যের স্টকলটের ব্যবসা শুরু করে। একপর্যায়ে শাহেদ ও কাওছারসহ অন্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে অবৈধ পথে কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক হয়েছে।