অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশানের কথা বাদ দিলে ঢাকার বাকি সব রাস্তায় যানবাহন নিয়ন্ত্রিত হয় ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায়। ট্রাফিক সংকেত–ব্যবস্থা কার্যকর না থাকলেও লাল, হলুদ ও সবুজ বাতির কোনটি কখন জ্বললে কী করতে হবে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। গাড়ি কখন থামবে, কখন চলবে—তা সংকেত বাতি দেখে সহজেই বুঝতে পারেন সাধারণ মানুষ।
তবে দুর্যোগের ক্ষেত্রে কোন সংকেত দেখালে কী করণীয় কিংবা কোন সংকেত কী অর্থ বহন করে, সেটি চট করে বুঝে ওঠা সহজ নয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘূর্ণিঝড়ের সময় মানুষকে সতর্ক করতে যে সংকেত–ব্যবস্থা চালু রেখেছে, সেটি সাধারণ মানুষের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই বোধগম্য নয়।
যেমন দূরবর্তী সতর্কসংকেত, দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত, স্থানীয় সতর্কসংকেত, স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত এসব বিষয় বহু বছর ধরে মানুষ শুনে এলেও কোনটিতে কোন মাত্রায় বিপদ আসছে, তা কতজন সঠিকভাবে বুঝতে পারেন, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
একইভাবে বিপৎসংকেত ৫, ৬ ও ৭ এর মধ্যে পার্থক্য কী? অথবা মহাবিপৎসংকেত তিনটি কেন (৮ নম্বর, ৯ নম্বর ও ১০ নম্বর)।
আবার ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত হঠাৎ ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত হয়ে যায় কীভাবে? এসব বিষয় সাধারণ মানুষের জন্য সহজ করে বলা যায় কীভাবে। অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে—দেশের মানুষ নানা মাধ্যমে এই খবর গত দুদিন ধরেই জেনে আসছে। শুক্রবার (১২ মে) দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে কেমন করে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত হয়ে উঠল—এই বিষয় অনেকের কাছে হয়তো বোধগম্য নয়।
সাধারণ মানুষ যাতে সহজে বুঝতে পারেন, এ জন্য বিদ্যমান সংকেত–ব্যবস্থার সংস্কার দরকার—এমন আলোচনা বহুদিন ধরেই চলছে। দুর্যোগবিষয়ক লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা বলেছেন, বর্তমান সংকেত–ব্যবস্থায় মানুষ তো বিপৎসীমার অর্থই বোঝেন না। সতর্কতার নম্বর দিয়ে বিপদ বিবেচনা করলে হবে না। কারণ, এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্নের বিষয় রয়েছে। পুরোনো আমলের আইন দিয়ে এসব সতর্কতা কাজে আসছে না।
গওহার নঈম ওয়ারা জানান, ‘সাইক্লোন–জলোচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সতর্কতা জারি হয় জাহাজের ক্যাপ্টেন আর বন্দরের প্রশাসকের উদ্দেশে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এক আইনের ভিত্তিতে বন্দরকেন্দ্রিক সতর্কতা প্রচার করার রেওয়াজ এখনো চলছে।’
মানুষকেন্দ্রিক পূর্বাভাস আর সতর্কবার্তা যেকোনো দুর্যোগে জীবন–জীবিকা ও সম্পদ রক্ষা আর ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রভূত সাহায্য করে বলে মনে করেন গওহার নঈম ওয়ারা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে কোন সংকেতে কী বুঝায়, সেটি বলে দেওয়া আছে। একবার জেনে নেওয়া যাক, কোন সংকেতের মাধ্যমে কী বুঝতে হবে—
১ নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত
জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে পারে। দূরবর্তী এলাকায় একটি ঝড়ো হাওয়ার অঞ্চল রয়েছে, যেখানে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার (কিমি) যা সামুদ্রিক ঝড়ে পরিণত হতে পারে।
২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত
দূরে গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি। বন্দর এখনই ঝড়ের কবলিত হবে না, তবে বন্দর ত্যাগকারী জাহাজ পথে বিপদে পড়তে পারে।
৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত
বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর দুর্যোগকবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিমি হতে পারে।
৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত
বন্দর ঘূর্ণিঝড়কবলিত। বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ঘণ্টায় ৫১-৬১ কিমি। তবে ঘূর্ণিঝড়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার মতো তেমন বিপজ্জনক সময় এখনো আসেনি।
৫ নম্বর বিপৎসংকেত
বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতার ঝঞ্ঝাবহুল এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
৬ নম্বর বিপৎসংকেত
বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতার ঝঞ্ঝাবহুল এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
৭ নম্বর বিপৎসংকেত
বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতার ঝঞ্ঝাবহুল এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরের ওপর বা এর নিকট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত
বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে পারে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।
৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত
বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।
১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত
বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা তার বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরের ওপর বা নিকট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে।
১১ নম্বর যোগাযোগবিচ্ছিন্ন সংকেত
আবহাওয়ার বিপদ সংকেত প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং স্থানীয় আবহাওয়া কর্মকর্তা পরিস্থিতি দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, সংকেতগুলোর মধ্যে ৫, ৬ ও ৭ নম্বর বিপৎসংকেতের মাত্রা একই। আবার ৮, ৯ ও ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেতেরও মাত্রা এক। মূলত ঝড় সমুদ্রবন্দরের কোন দিক দিয়ে যাবে, তার ভিত্তিতে নম্বর আলাদা করা হয়, যদিও বিপদ সব ক্ষেত্রেই সমান।
নদীবন্দরের জন্য সতর্কসংকেত আলাদা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে যা বলা আছে
১ নম্বর নৌ সতর্কসংকেত
বন্দর এলাকা ক্ষণস্থায়ী ঝোড়ো আবহাওয়ার কবলে পড়তে পারে, এমন শঙ্কা রয়েছে। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিমি গতিবেগের কালবৈশাখীর ক্ষেত্রেও এই সংকেত প্রদর্শিত হয়। এই সংকেত আবহাওয়ার চলতি অবস্থার ওপর সতর্ক নজর রাখারও তাগিদ দেয়।
২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত
বন্দর এলাকা নিম্নচাপের সমতুল্য তীব্রতার একটি ঝড়, যার গতিবেগ ঘণ্টায় অনূর্ধ্ব ৬১ কিমি বা একটি কালবৈশাখী ঝড়, যার বাতাসের গতিবেগ ৬১ কিমি বা তদূর্ধ্ব। নৌযান—এগুলোর যেকোনোটির কবলে পড়তে পারে, এমন শঙ্কা রয়েছে। ৬৫ ফুট বা তার কম দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট নৌযানকে দ্রত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে।
৩ নম্বর নৌ বিপৎসংকেত
বন্দর এলাকা ঝড়কবলিত। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ একটানা ৬২-৮৮ কিমি পর্যন্ত গতিবেগের একটি সামুদ্রিক ঝড় শিগগিরই বন্দর এলাকায় আঘাত হানতে পারে। সব ধরনের নৌযানকে অবিলম্বে নিরাপদ আশ্রয় নিতে হবে।
৪ নম্বর নৌ মহাবিপৎসংকেত
বন্দর এলাকা একটি প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার সামুদ্রিক ঝড়ে কবলিত এবং শিগগিরই বন্দর এলাকায় আঘাত হানবে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি বা তদূর্ধ্ব। সব ধরনের নৌযানকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে হবে।
অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলায় ১২ মে রাতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘অ্যালার্ট–৪’ (৪ নম্বর মহাবিপৎসংকেত) জারি করেছে।
অ্যালার্ট–৪ জারি হলে জেটি থেকে কেন জাহাজ সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, বড় জাহাজগুলো জেটিতে থাকলে ঢেউয়ের কারণে জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে সাগরে জাহাজগুলো ইঞ্জিন চালু রেখে ঢেউ বা ঝড়ের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে ভাসতে পারে। এ জন্য দুর্ঘটনা এড়াতে বড় জাহাজগুলো সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, আবহাওয়া অধিদপ্তর মহাবিপৎসংকেত ৮, ৯ ও ১০ জারি করলে বন্দরেও সর্বোচ্চ সতর্কতা বা অ্যালার্ট-৪ জারি করা হয়। সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি হলে বন্দর জেটিতে অবস্থানরত জাহাজগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতির মধ্যেই দেশে আবহাওয়ার সংকেতব্যবস্থা নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে আবহাওয়াবিদদের সংগঠন সাউথ এশিয়ান মেটারোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (সামা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহন কুমার দাশ বলেন, সতর্কসংকেত দেওয়ার ক্ষেত্রে বন্দরকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে বিকল্প কিছু ভাবার সময় এসেছে। প্রায় এক যুগ আগে ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কসংকেত ব্যবস্থা পর্যালোচনা এবং তা পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত বেশি দূর এগোয়নি। দুর্যোগের ক্ষেত্রে পূর্বাভাস ব্যবস্থা এখন অনেক আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে। সাধারণ মানুষ যাতে সহজে বিপদ ও ঝুঁকির মাত্রা বুঝতে পারেন, সে ধরনের পদ্ধতির দিকে বাংলাদেশকেও যেতে হবে।