উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) এক বঁটির দাম ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে ২০২০ সালে বেশ আলোড়ন তুলেছিল ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পটি। শুরু থেকে অনিয়মের ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্পটি এখনও হাঁটছে সে পথেই। যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল কৃষক যাতে ফসল উৎপাদন বাড়াতে, সময় বাঁচাতে ও মুনাফা নিশ্চিত করতে পারে। তবে অনুসন্ধান বলছে– কৃষক নয়, ‘মুনাফা নিশ্চিত’ করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্তারা। কৃষিকে লাভজনক, বাণিজ্যিকীকরণ ও আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে সরকার জোর দিচ্ছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে, আর কিছু অসাধু কর্মকর্তা মেতেছেন লুটপাটতন্ত্রে। পাঁচ বছরের এই প্রকল্পটির মাঝপথ পেরোতেই রকমারি দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক তদন্তের জন্য নথি পাঠায় কৃষি মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় এ বছর তদন্ত কমিটি করেই হাঁপিয়ে গেছে। তদন্ত প্রতিবেদন আজও দেখেনি আলোর মুখ। এখানেই শেষ নয়, খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত ৩০ জুন প্রকাশিত নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে প্রকল্পে দুর্নীতির ‘আমলনামা’।
শুধু ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পটিই নয়, এর আগে ২০১০ সালে কৃষকদের আধুনিকায়নের জন্য সরকারের নেওয়া প্রথম উদ্যোগেও লেগে আছে হরিলুটের দাগ। ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন’ ১০ বছরের প্রকল্পটিও ছিল ‘পুকুরচুরি’তে ভরা। উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) কৃষি যান্ত্রিকীকরণে দুটি বড় প্রকল্প হাতে নিলেও বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না।
ওই প্রকল্প চলাকালে মাঠ পর্যায়ে অনিয়ম এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, বগুড়ার ধুনটের কৃষি কর্মকর্তা মুশিদুল হকের বিরুদ্ধে কম্বাইন হারভেস্টারের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বাধ্য হয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ১০ উপজেলায় সমকাল খবর নিয়ে এ রকম আরও অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। এত অভিযোগের পরও প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শেখ নাজিম উদ্দিনকে দেওয়া হয় আরেকটি নতুন প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুতের দায়িত্ব। সেই কাজেও তাঁর সঙ্গী ছিলেন উপপ্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম শেখ। প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের ডিপিপিতে একটি বঁটির অবিশ্বাস্য দাম নির্ধারণ করে ব্যাপক আলোচনায় আসা শেখ নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগে করা হয় বিভাগীয় মামলা। তবে তাঁর হয়নি কোনো শাস্তি। বর্তমানে তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মানিকগঞ্জ কার্যালয়ে কর্মরত। শফিকুল ইসলাম শেখকে নতুন যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ডিপিডি করা হয়। দুই প্রকল্প মিলিয়ে ১৪ বছর ধরে এ পদে আছেন তিনি। তারা দু’জনই নতুন প্রকল্পের পরিচালক হতে তদবির চালালেও শেষমেশ প্রকল্প পরিচালক করা হয় ড. বেনজীর আলমকে। প্রকল্প পরিচালক হতে না পেরে দু’জন মিলে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকল্পেও অনিয়মের ধারা
সরকার ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল মেয়াদে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প হাতে নেয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের ১২ ধরনের ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র দেওয়ার কথা। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। তবে শুরু থেকেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বৃত্তে প্রকল্পটি। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান মো. বেনজীর আলম। এর আগে তিনি যে প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন, সে সময়ও তাঁর বিরুদ্ধে ছিল নানা অনিয়মের অভিযোগ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পদোন্নতি পেয়ে বেনজীর আলম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হন। এর মাস ছয়েক পর নতুন প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পান তারিক মাহমুদুল ইসলাম। এ প্রকল্পে অভিযোগের তীর ছিল বেনজীর আলমের দিকে। তবে জবাবদিহির আওতায় না এনে উল্টো মহাপরিচালক থেকে অবসরের আগে তাঁকে এ বছর গ্রেড-১ পদমর্যাদা দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। মহাপরিচালক থাকাকালে প্রকল্পের অনিয়ম, দুদকে অভিযোগ ও তদন্ত বিষয়ে বেনজীর আলম বলেন, ‘আমার সময়ে কোনো অনিয়ম হয়নি। কিছু হয়ে থাকলে তা আমার পরে হয়েছে।’ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার আগে যিনি প্রকল্প পরিচালক ছিলেন, এগুলোর বেশির ভাগই তাঁর সময়কার দেওয়া অডিট আপত্তি। তিনি হয়তো এগুলো খেয়াল করেননি। আমি দায়িত্বে আসার পর এগুলো নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।’
সিডার যন্ত্রে নয়ছয়
সমকালের অনুসন্ধানেও বেশ কিছু জেলায় অনিয়মের খোঁজ মিলেছে। প্রতিটি সিডার যন্ত্র কেনায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। বরগুনায় সরকারের দেওয়া একটি সিডার যন্ত্রের বাজারদর ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে ৭০ শতাংশ। ফলে ৮৫ হাজার টাকা জমা দিয়েই সিডার যন্ত্র পাওয়ার কথা। এ যন্ত্র কেনায় কৃষকদের জমা দিতে হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বরগুনা সদর ইউনিয়নের পাজরাভাঙ্গা গ্রামের কৃষক ফরিদ মিয়া বলেন, ‘আমি কৃষি অফিসে ১ লাখ ২৩ হাজার টাকা জমা দিয়ে সিডার যন্ত্র নিয়ে এসেছি। আমাকে টাকা জমা নেওয়ার কোনো স্লিপ অফিস থেকে দেওয়া হয়নি।’ বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে মাসিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় ৭১২টি সিডার যন্ত্র বরাদ্দ হয়। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, যাদের তালিকায় নাম আছে, তারা পাওয়ার সিডার যন্ত্র নেননি। আবার অনেকে তিন-চারটি পাওয়ার সিডার যন্ত্র পেয়েছেন।
কারা কী বলছেন
শুরু থেকেই প্রকল্পের কারিগরি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আইয়ুব হোসেন। তিনি বলেন, কোম্পানির যন্ত্রগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি। সব যন্ত্রই খুব ভালো মানের ছিল। তবে কৃষকের হাতে ভালো যন্ত্র যাচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের। প্রকল্পের ডিপিডি আলতাফুন্নাহার বলেন, প্রকল্প শুরুর পর দুই বছর করোনার প্রকোপ ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা মাঠে কাজ করেছি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা হতো ৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৬ শতাংশে। যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে বছরে ২ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের সফলতা কম নয়। বিশেষ করে কয়েক বছরে হাওরে তা দৃশ্যমান। তবে অনিময় না হলে এটির সুফল আরও অনেক প্রান্তিক কৃষক পেতেন।’ কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘প্রকল্পের কারণে দ্রুত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। কৃষকের সাশ্রয় হচ্ছে, ক্ষতি কমছে। মাঠ পর্যায়ে কোনো অভিযোগ থাকলে আমরা খতিয়ে দেখব।’