কত যে অচেনা আম

0
195
হাতিঝোলা ও বউ-ভোলানো আম। রং-রস-স্বাদ-গন্ধে অতুলনীয়, অথচ জাতীয় স্তরে রাজশাহীর বাঘার এই আম পরিচয়হীন

আমের নাম গোল্লা। আমটি খাওয়ার পর আপনার মনে হবে, নামটি মোটেই যথার্থ হয়নি। রসে ভরা সুমিষ্ট এই আমের নাম হওয়া উচিত ছিল রসগোল্লা।

বহু বছর আগে রাজশাহীর বাঘায় একটি আমের আঁটি থেকে জন্ম নেওয়া এই আমের আকার ছোট বলেই হয়তো কেউ এর নাম দিয়েছেন গোল্লা। শুধু গোল্লা নয়, বাঘায় এ রকম শতাধিক প্রকৃতিগত আমের জাত রয়েছে। রং-রস-স্বাদ-গন্ধে সেসব অতুলনীয়, অথচ জাতীয় স্তরে তারা পরিচয়হীন।

গত মাসে বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় আয়োজিত কৃষিপ্রযুক্তি মেলায় চাষিরা এমন শত জাতের আম নিয়ে হাজির হন। অনেক আমের নাম বাঘার বাইরের মানুষ হয়তো কোনো দিনই শোনেননি। নাম দিয়েছেন গাছের স্বত্বাধিকারীরা। সম্প্রতি বাঘার আমচাষিদের সঙ্গে কথা বলে এসব আমের আত্মপরিচয়ের অভিনব তথ্য পাওয়া গেছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম যাচ্ছে স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনে

এই আমের নাম বাবুইঝুকি।
এই আমের নাম বাবুইঝুকি।

গোল্লা আমের গাছটি রয়েছে উপজেলার চকআমোদপুর গ্রামে। গাছের মালিক আকবর আলী। তাঁর বাবা প্রয়াত সাবের উদ্দিন সরকারের মুখেই শুনেছেন, এই আমের নাম গোল্লা। আকবর আলীর ভাষ্য, আমটা শুধু আকারে ছোট; কিন্তু ফলন প্রচুর, পরিচর্যার জন্য বালাইনাশকেরও তেমন প্রয়োজন পড়ে না। এই আম শুধু বাড়িতে খাওয়া হয় আর পাঠানো হয় কুটুমবাড়িতে।

আকবর আলীর ভাতিজা রাজীব আহমেদ একটি আম কেটে দিলেন। মুখে দিয়েই মনে হলো অপূর্ব। কোনো আঁশ নেই, মিষ্টি রসে রসনার তৃপ্তি হলো।

আকবর আলীর আনারসি নামের আরেক জাতের আম রয়েছে। খেতে আনারসের মতো স্বাদ। খাওয়ার সময় রস চুইয়ে পড়ে। এ কারণেই সম্ভবত আনারসি নামটি রাখা হয়েছে।

আরেকটি আম ইঁদুরচাটা। উপজেলার খোদ্দবাউসা গ্রামে গিয়ে পাওয়া গেল চাষি ইমরুল ইসলামকে। তিনিসহ চার-পাঁচজন চাষির কাছে এই জাতের আম রয়েছে। এই আম তাঁরা বিক্রি করেন না। নিজেরা খান আর মেহমানদারি করেন। জানা গেল, বেরেস নামে একজন ক্ষৌরকারের কাছে এই আমের একটিমাত্র গাছ ছিল। সেটি থেকে তাঁরা কলম করেছেন। খেতে সুস্বাদু, আঁশ নেই। লম্বাটে আকারের এই আম পাকার পরেও সহজে পচে না। বেশ কিছুদিন রাখা যায়। তাই মৌসুম প্রায় শেষ হয়ে এলেও তাঁর বাসায় কয়েকটি আম পাওয়া গেল। স্বাদ নিয়ে তার কথার প্রমাণও পাওয়া গেল।

ইমরুল ইসলামেরই কাছে রয়েছে বউ-ভোলানো আম। সুন্দর রং, আকারে চ্যাপ্টা, আঁশ নেই। খেতে সুস্বাদু। ইমরুল জানেন না, কীভাবে এই জাত পেয়েছেন। তাঁর কাছে বাবুইঝুঁকি নামের আরেক জাতের আম আছে। আকারে ছোট বলে বাচ্চাদের পছন্দ। খেতে ভালো, তবে হালকা আঁশ আছে। এই আম এলাকায় খুব কম।

আমের সাতসতেরো

জগৎমোহিনী আমটি আছে উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের আদর্শ চাষি এনামুল হকের কাছে। এই আম ফজলি আমের সঙ্গে পাকে। বোঁটা শক্ত। অল্প ঝড়ে ঝরে পড়ে না। এক ঝোপায় তিনি ২১টি পর্যন্ত আম পেয়েছেন। একেকটি আম আধা কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। খেতেও ভালো। এনামুলের বাগানে গিয়ে এবার এক ঝোপায় আম পাওয়া গেল পাঁচটি।

উপজেলার বলিহার গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের হাতিঝোলা জাতের আমগাছ রয়েছে। এই আমের ওজন এক কেজি পর্যন্ত হয়। মিষ্টি সামান্য কম।

এমন অচেনা জাতের আরও কিছু আমের নাম ও স্বাদের পরিচয় পাওয়া গেল। যেমন ফনিয়া, জহুরা, লাখে এক, খাজা গুটি, চিনিঘোরা, চুঙ্গাভোগ, বিবি, চাপড়া, ডুকসা, হাতিম, কৃষাণভোগ, কাদুমা, বেলি, দুধসর, দুধকোমর, আপেল গুটি, চেংসাই, ডকমাই, ভাদরী, নাকাবাসী, সুমাসি, জগৎমোহনী, দিংলি, হাতিঝোপা, কদালকাটি, সিন্দুরটোকা, আনারসি, জাওনি, পাগাড়ে, স্বপ্নবিভর, ঝিনুক, দুধভরা, বৈশাখী, ভুরই, কালুয়া গুটি, আনারকলি, বিশ্বনাথ, বাঘাশাহি, বঙ্গবাসী, আষাঢ়ি, ছাতু ভিজালি, বাতাসী, ধমিয়া, মোহনঠাকুর, মেথা ফকিন্নী, মিছরিছানা, সালাম ভোগ, খালসি, মধু খালসি, পেঁপে গুটি, পেপসি গুটি, কাঁকড়ি, সুগন্ধি গুটি, নাজিরভোগ, বালিশ গুটি, মধু চুষকা, আবদুল্লাহ ফজলি, কালিভোগ, মধুমতী ও জামাইভোগ, চমন বাহার, সন্দেশি, সুমাশি ও খোদা দাদা।

গরমে আগেই পেকেছে আম, দাম নিয়ে হতাশ চাষিরা

বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতানের একটি স্বপ্ন রয়েছে। কেউ যদি একসঙ্গে পাঁচ বিঘা জমি দেন, তাহলে এসব অচেনা আমগাছের একটি ‘ম্যাঙ্গো হেরিটেজ’ করতে চান তিনি। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ বাগানটি দেখতে আসবেন, আম খাবেন, কিনবেন। বাঘা এমনিতেই ইতিহাসে সমৃদ্ধ। তেমন কিছু হলে আমের সুবাদে বাঘার সঙ্গে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.