এর চেয়ে বড় গোঁজামিল আর হতে পারে না

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যবিশেষ ফেলো, সিপিডি

0
139
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

তিন মেয়াদে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা সরকার বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেটে তার অর্জনগুলোকে তুলে ধরবে তা প্রত্যাশিত, কিন্তু সেই সঙ্গে দেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের স্বীকৃতি থাকবে বলে প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু সংকট ও সমস্যার স্বীকৃতি বা উপলব্ধি যেহেতু নেই, তাই সমস্যা সমাধানের পথ অস্পষ্ট এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।

একটি উদাহরণ হলো মূল্যস্ফীতি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, স্বল্প মেয়াদে মূল্যস্ফীতির সুরাহা হবে না। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব কথা বাজেট বক্তৃতায় বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বলা হয়েছে, তা থেকে একটি সুচিন্তিত সুগ্রথিত কার্যকাঠামো বের হয়ে আসে না। আমদানি নিয়ন্ত্রণ, কৃচ্ছ্রসাধন, কৃষিঋণ বৃদ্ধি, নীতি সুদহার বৃদ্ধি, মুদ্রা বিনিময় হার সমন্বয় ইত্যাদি বিষয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপের কারণে সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। কারণ হলো, মুদ্রানীতি, বাণিজ্যনীতি, রাজস্বনীতি বা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ—

বাজেটে বাস্তবতা কম, স্বস্তির চেয়ে চাপ বেশি

বাজেট ২০২৩–২৪
বাজেট ২০২৩–২৪

এসব কিছুর সমন্বিত সমহারভিত্তিক পথ রেখায় নেই। অনেক ক্ষেত্রে এসব পদক্ষেপ যে একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষিত, সেই বিবেচনাও নেই। এর বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে সমন্বয়ক ও নেতৃত্বমূলক ভূমিকা থাকতে হয়, সেটাও নেই।

আয়-ব্যয়ের যে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে দেশে, তাতে সব সময় দুর্বলতা থাকবে। কিন্তু এবারের বাজেটের দুর্বলতাটা শুধু কাঠামোতে নয়। কারণ, বাজেট ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, কাঙ্ক্ষিত ব্যয় মেটাতে গিয়ে কর আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, সেটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কিন্তু তারপরও আইএমএফকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে প্রতিবছর যে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব বৃদ্ধির কথা আছে, সেই লক্ষ্যমাত্রা চেষ্টা করেও এই প্রাক্কলনে প্রতিফলিত হয়নি।

ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভৌত অবকাঠামোর প্রাধান্য রয়ে গেল। জাতীয় আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দে কোনো ধরনের পরিসংখ্যানগত পরিবর্তন হয়নি। সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দও জিডিপির হিসাবে ও টাকার অঙ্কে কমে যাবে। এটা নিয়ে বিতর্ক হবে। যদিও কতিপয় ভাতা সামান্য বাড়ানো হয়েছে।

দাম বাড়তে পারে যেসব পণ্য ও সেবার

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করেনছবি: বাসস

তবে বাজেট ঘাটতি নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। ঘাটতি পূরণে বিদেশি ঋণনির্ভরতা ও দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আরও বাড়বে। সরকারের এই ব্যাংক নির্ভরতার প্রতিফলন নিঃসন্দেহে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যাবে। বলা দরকার, বিদায়ী অর্থবছরে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির অংশের হিসাবে প্রায় ২ শতাংশ কমে গেছে, ২৩ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশের ঘরে চলে এসেছে। লক্ষণীয় হলো, সেই ব্যক্তি বিনিয়োগ আগামী অর্থবছরে এক লাফে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ হয়ে যাবে বলা হয়েছে। এর চেয়ে বড় গোঁজামিল আর হতে পারে না।

প্রবৃদ্ধির যে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা আগামী বছরের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাকে ঠেকা দেওয়ার জন্য ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের এই অবাস্তব হিসাব করা হয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তো ইচ্ছামাফিক বাড়িয়ে দেখানো যায় না। ব্যক্তি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধির এই হিসাব যাঁরা করেছেন, তাঁরা ভুলে গেছেন যে অর্থনীতির অন্যান্য সূচক এর সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়লে ঋণপ্রবাহ বাড়বে, কিন্তু ঋণপ্রবাহের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তা এত বিনিয়োগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আবার বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ব্যাপকভাবে ঋণ নিলে, ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবাহে টান পড়ে। টাকা আসবে কী করে? আবার ব্যক্তি খাতের ঋণ বাড়লে আমদানি বাড়বে, আমদানি বাড়লে আমদানি শুল্ক আদায় বাড়বে, কিন্তু শুল্ক বৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান, তার সঙ্গে ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির সামঞ্জস্য নেই।

দাম কমতে পারে যেসব পণ্য ও সেবার

এককথায় রাজস্ব কাঠামো তথা প্রবৃদ্ধি সম্পর্কিত প্রাক্কলনে পেশাদারির অভাব দেখা যায়। অথচ রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু ব্যয়মুখী বাজেট দেওয়ার চেষ্টা নেই। তাই এর কারণ বোধ হয় অর্থ জোগাড় হলেও কার্যকরভাবে ব্যয় করার সক্ষমতা নেই। যাঁরা নির্বাচনী বাজেট দেখার অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁরা হতাশ হবেন। এ বাজেটে মনকাড়া জনতুষ্টিমূলক কাজ নেই, যদিও পরিবেশ সম্পর্কিত বেশ কিছু ভালো প্রস্তাবনা রয়েছে।

আবার দেখি, যাঁদের করযোগ্য আয় নেই, তাঁদের ওপর দুই হাজার টাকা করে কর প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে সম্পদশালীদের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে সারচার্জের ওপর রেয়াত। এটা করনীতির ন্যায্যতার বরখেলাপ। ফলে মনে হয় না, এই বাজেট প্রণয়নে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চিন্তা যথাযথভাবে কাজ করেছে।

এই সরকার তিন ধাপে গত ১৫ বছরে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ভালো-মন্দ মিলিয়ে অনেক কিছুই করেছে। এই অর্জন ও অভিজ্ঞতার প্রতি এই রেখাটানা বাজেট সুবিচার করতে পারল না। আর বাজেট উপস্থাপনা বিশ্বব্যাপী যে প্রথা ও গাম্ভীর্য, তা তো আগেই ক্ষুণ্ন হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.