এনায়েত করিমকে বিমানবন্দরে আনতে যান ডিআইজি, পাঁচ তারকা হোটেলের ভাড়া দেন জাপা নেতা

0
13
এনায়েত করিম ওরফে মাসুদ করিম চৌধুরী

বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা দাবি করা এনায়েত করিম ওরফে মাসুদ করিম চৌধুরীকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আনতে যান পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। এমনকি এনায়েত করিমের নিরাপত্তায় নিজের দেহরক্ষীকে (একজন পুলিশ সদস্য) নিয়োজিত করেছিলেন তিনি। গ্রেপ্তারের সময় ওই দেহরক্ষী এনায়েত করিমের সঙ্গেই ছিলেন। দেহরক্ষীকে এরই মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে ডিআইজির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আসার পর এনায়েত করিম দুদিন একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ছিলেন। ওই হোটেল বুকিং ও তার ভাড়া পরিশোধ করেছিলেন জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী অংশের মহাসচিব পরিচয় দেওয়া কাজী মামুনুর রশিদ। গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে এনায়েত করিম এসব তথ্য দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এর আগে গত শনিবার এনায়েত করিমকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর ৫৪ ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে রমনা থানায় মামলা হয়েছে। ওই মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল সোমবার ওই মামলায় আদালত এনায়েত করিমকে রিমান্ডে নিয়ে ৪৮ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে জব্দ করা পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. শফিকুল ইসলাম আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর বলেন, এনায়েত করিমকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের বিষয়ে জানা গেছে। তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে ওই সব সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেও আইনের আওতায় আনা হবে। তবে এখন পর্যন্ত এনায়েত করিমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, এনায়েত করিম ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয়ে বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর স্বপ্ন দেখিয়ে, কখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল ডিনারে আমন্ত্রণ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তিনি নেতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও অনেক নেতার কাছ থেকে অর্থ নেন। ২০১৮ সালের পর বিএনপিপন্থী এক সাংবাদিক নেতা এবং নবগঠিত একটি দলের নেতার সঙ্গে সখ্য গড়েও এনায়েত করিম প্রতারণা চালিয়ে গেছেন। এই দুজনের সঙ্গে এখনো এনায়েত করিমের যোগাযোগ অব্যাহত আছে। এর আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলেও (২০০১-০৬ সাল) একবার এনায়েত করিমকে প্রতারণার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

এনায়েত করিমের প্রতারণার বিষয়ে একটি সূত্র জানিয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত একজনকে বাঁচানোর আশ্বাস দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে কয়েকজন র‍্যাব কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসে। তখনো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচানোর নামে এনায়েত করিম অনেক সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জাতীয় পার্টির নেতা যা বললেন

জাতীয় পার্টির রওশনপন্থী অংশের মহাসচিব হিসেবে পরিচয় দেওয়া কাজী মামুনুর রশিদ বলেন, এনায়েত করিমের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্পর্ক। সেই সম্পর্কও দীর্ঘদিনের। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সঙ্গেও এনায়েত করিমের সখ্য ছিল। এনায়েত করিম বাংলাদেশে এলে এরশাদের সঙ্গে দেখা করতেন। মূলত পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণেই এনায়েত করিম বাংলাদেশে এলে তিনি আপ্যায়ন করতেন। এবারও তিনি হোটেল বুকিং ও ভাড়া পরিশোধ করেছেন। মামুনুর রশিদ যখন যুক্তরাষ্ট্রে যান, তখন এনায়েত করিম তাঁকে আপ্যায়ন করেন। এখানে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক ছাড়া অন্য কিছু নেই।

কাজী মামুনুর রশিদ দাবি করেন, এনায়েত করিমের বিদেশি সংস্থার এজেন্ট পরিচয় দেওয়া বা প্রতারণার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। সরকার পতনের ষড়যন্ত্র বা অন্য কোনো বিষয়েও তিনি কিছু জানেন না।

ডিআইজির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেই

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের বিশেষ শাখার তথ্যের ভিত্তিতে ডিবির সহায়তায় শনিবার এনায়েত করিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন এনায়েত করিম একটি প্রাডো গাড়িতে করে সন্দেহজনকভাবে মিন্টো রোড এলাকায় ঘোরাফেরা করছিলেন। ওই প্রাডো গাড়ি ভাড়া করে দিয়েছিলেন পুলিশে কর্মরত একজন ডিআইজি। পদাধিকার বলে ওই ডিআইজির নিরাপত্তার জন্য একজন দেহরক্ষী (একজন পুলিশ সদস্য) নিয়োজিত থাকেন। এনায়েত করিমকে গ্রেপ্তারের সময় প্রাডো গাড়িতে ওই দেহরক্ষীও ছিলেন। দেহরক্ষী জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তিনি কেবল ডিআইজির নির্দেশনা পালন করেছেন।

২০২১ সালের ২১ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এনায়েত করিম বিএনপিসহ একাধিক দলের বিভিন্ন নেতাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তখন তিনি তাঁদের কাছে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী সংস্থার লোক বলে পরিচয় দেন। তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে এনায়েত করিম ব্যাংকক ও নেপালে একাধিক বৈঠকও করেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, ব্যাংককের বৈঠকে চাকরিচ্যুত এবং অবসরপ্রাপ্ত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানো ডিআইজিও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.