সম্প্রতি ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলে দেশটির সেনাদের হটিয়ে বেশ ভেতরে ঢুকেছে রুশ বাহিনী। দখল করে নিয়েছে বেশ কিছু এলাকা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের রুখে দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনের সেনারা। তীব্র এই যুদ্ধের মধ্যে খারকিভে আসলে কী ঘটছে, তা দেখতে অঞ্চলটিতে গিয়েছেন বিবিসির প্রতিরক্ষাবিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথন বেল। নিজ চোখে দেখা সব অভিজ্ঞতা পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন তিনি।
ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলের লিপৎসি গ্রামের দিকে দ্রতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। গ্রামটি বর্তমানে অবরোধ করে রেখেছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। গ্রামটি এ অঞ্চলের রাজধানী খারকিভ শহরের উত্তরে। ইউক্রেন বাহিনীকে হটিয়ে সীমান্তবর্তী এই এলাকায় প্রবেশ করেছেন রুশ সেনারা।
আমাদের সঙ্গে ছিলেন ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা। লিপৎসি গ্রাম ঘিরে রাশিয়ার অগ্রগতি রুখে দিতে তাঁদের সেখানে পাঠানো হচ্ছে। এর আগে তাঁরা পূ্র্বে রুশ বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এখন তাঁদের আরও উত্তরে সরিয়ে আনা হচ্ছে। কোনো বিশ্রাম ছাড়াই যুদ্ধ করে যাচ্ছেন এই সেনারা।
এই সেনাসদস্যদের যেখানে মোতায়েন করা হবে, সেখানে পৌঁছালাম আমরা। এর অবস্থান যুদ্ধের সম্মুখসারি থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। আমাদের কানে ভেসে আসছিল কামানের গোলার শব্দ। জ্বলতে থাকা আগুনের কুণ্ডলী পেরিয়ে আমরা একটি বাংকারের দিকে দৌড় দিলাম। সেখানেই আমাদের আশ্রয় নিতে বলা হয়েছিল।
বাংকারের নিচে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে আলো-আঁধারির মধ্যে ইউক্রেনের একদল সেনাসদস্যকে দেখতে পেলাম। ড্রোন থেকে নেওয়া ভিডিও চিত্র খতিয়ে দেখছিলেন তাঁরা। তারপর সে অনুযায়ী কামান থেকে হামলা চালানোর নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। আন্দ্রি নামের একজন সেনাসদস্য বললেন, এই লড়াইয়ের মধ্যে কখন কী হবে, তা অনুমান করা কঠিন।
আমাদের বলা হয়েছিল, বাংকারে আমরা বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। সেখানে মাটির নিচেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি আন্দ্রির কাছে জানতে চাইলাম, তিনি এবং তাঁর দলের সদস্যরা এখানে আসার ফলে যুদ্ধে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না? জবাবে তিনি বললেন, তুলনামূলক কিছুটা হয়তো এসেছে। তবে নতুন কোনো জায়গায় গিয়ে লড়াইয়ে অংশ নেওয়াটা কঠিন।
আমাদের কথোপকথন চলাকালে বাইরে আঁধার ঘনিয়ে আসছিল। অন্ধকারের মধ্যেও বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রুশ বাহিনীর গতিবিধি ভিডিও করে পাঠাচ্ছিল ইউক্রেনের ড্রোনগুলো। আন্দ্রেই হঠাৎ বললেন, ‘এইমাত্র আমাদের অবস্থানের কাছেই শত্রুদের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন ড্রোনের পাইলট।’ তারপর সেখান থেকে দ্রুত আমাদের সরে যেতে বলা হলো।
রাশিয়ার সেনাসংখ্যা অনেক বেশি
এরপর আমরা গেলাম যুদ্ধের সম্মুখসারির বেশ পেছনে একটি অস্থায়ী হাসপাতালে। সেখানে আহত ইউক্রেনীয় সেনাদের চিকিৎসা চলছিল। তাঁদের একজন ভিক্তর। মর্টার বিস্ফোরণে কয়েকটি আঙুল হারিয়েছেন। হাসপাতালের একটি বিছানায় কম্বল গায়ে শুয়ে ছিলেন তিনি।
নিজের চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে আসা দলের সদস্যদের নিয়ে বেশি বিচলিত হয়ে পড়েছেন ভিক্তর। তিনি বললেন, ‘দলের সদস্যদের ছাড়া আমি থাকতে পারছি না। তাঁরা আমার বন্ধু। আমার দ্বিতীয় পরিবার।’ ভিক্তর জানালেন, যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের কাছে আবার ফিরে যেতে চান তিনি।
যুদ্ধে রুশ বাহিনীও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ছে। তবে তাদের সেনাসংখ্যা অনেক বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, খারকিভ সীমান্তের ওপারে ৩০ হাজারের বেশি রুশ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এই অঞ্চলে যুদ্ধের সম্মুখসারিতে রাশিয়ার তুলনায় ইউক্রেনের সেনা কম। অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়েও পিছিয়ে রয়েছে তারা।
ভিক্তর বললেন, রাশিয়ার বাহিনী একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের সেনাসংখ্যাও অনেক। যুদ্ধে রুশ সেনারা যা যা চান, তার সবকিছুই তাঁদের দেওয়া হচ্ছে। আর ইউক্রেনের সেনাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য কিছুই নেই। তারপরও তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তায় বিলম্ব যুদ্ধটাকে ইউক্রেনীয় সেনাদের জন্য আরও কঠিন করে তুলেছে। গড় হিসাবে বর্তমানে ইউক্রেনের তুলনায় ১০ গুণ বেশি কামানের গোলা ছোড়ার সক্ষমতা রয়েছে রুশ বাহিনীর। কিয়েভের সামনে এখন একমাত্র আশা—মার্কিন অস্ত্র হাতে পেলে তাদের এই সংকট অনেকটা দূর হবে।
প্রতিরোধের এলাকা বাড়ছে
খারকিভের ভোভচানস্ক শহরে গাছপালার ভেতরে গোপন জায়গায় কামান মোতায়েন করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনীর ৫৭তম ব্রিগেড। শহরটি রক্ষায় সেখান থেকে দিনে ৫০ থেকে ১০০টি গোলা ছোড়া হয়। আমরা সেখানে গিয়ে দেখলাম, সেনারা গোলার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ বাদে ছোট একটি গাড়িতে করে ২০টি গোলা আনা হলো। এ দিয়ে তাঁরা আরও কয়েক ঘণ্টা হামলা চালাতে পারবেন।
৫৭তম ব্রিগেডের এই দলটিকে আগে আরও উত্তরে মোতায়েন করা ছিল। এখন তাদের খারকিভ রক্ষার জন্য আনা হয়েছে। দক্ষিণে রোবোতিন গ্রাম থেকে আনা হয়েছে আরেকটি ব্রিগেডের সেনাদের। ওই গ্রামটির দিকেও অগ্রসর হচ্ছে রুশ বাহিনী। রাশিয়ার হামলার মুখে ইউক্রেন বাহিনীকে এখন আরও বেশি এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হচ্ছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে বেশ কিছু অঞ্চল দখলে করে নেয় রাশিয়া। এরপর গত বছর পাল্টা হামলার মধ্য দিয়ে সামান্য কিছু অঞ্চল মুক্ত করতে সক্ষম হয় কিয়েভ। এখন সেই অর্জনটাও হারাতে বসেছে তারা। নতুন কোনো অঞ্চল মুক্ত করা নয়, রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করাই এখন তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
খারকিভে ইউক্রেনীয় সেনাসংখ্যা বাড়ানোর পর রুশ বাহিনীর অগ্রগতি কিছুটা হলেও ঠেকাতে সক্ষম হচ্ছে কিয়েভ। তবে এখানে একটি প্রশ্ন উঠেছে। তা হলো পুরো ইউক্রেনে যুদ্ধের সম্মুখসারি ১ হাজার ২৮৭ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। খারকিভে সেনা সরিয়ে আনার ফলে ওই সব অঞ্চলে প্রভাবটা কী হতে পারে?
খারকিভে যেসব এলাকায় রুশ বাহিনী সম্প্রতি অগ্রগতি পেয়েছে, সেখান থেকে তাদের পুরোপুরি পিছু হটানো কঠিন হবে। তবে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে রাশিয়ার এই অগ্রগতি ঠেকানো যেত বলে মনে করেন ইউক্রেনের আর্টিলারি বাহিনীর কমান্ডার মিখাইলো। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা ভোভচানস্ক শহর হারাতে বসেছি। এর আশপাশের গ্রামগুলোও হারানোর পথে। আমরা গাছের গুঁড়ি ও কংক্রিট ব্যবহার করেই (রুশ সেনাদের) প্রতিরোধ করতে পারতাম। এখন আমাদের কামানের গোলা ব্যবহার করতে হচ্ছে এবং অন্যত্র থেকে এখানে সেনাদের সরিয়ে আনতে হচ্ছে।’