২০১৯ সালের ২৮ জুলাই। বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের (বিআইএফএফএল) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এস এম ফরমানুল ইসলামকে ‘অন্যায়ভাবে ও জোরপূর্বক’ পদত্যাগপত্রে সই করিয়ে অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন তখনকার অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার।
রউফ তালুকদার পদাধিকারবলে তখন বিআইএফএফএলের চেয়ারম্যান। ফরমানুল ইসলাম অফিস থেকে চলে আসার সময় আব্দুর রউফ তালুকদার তাঁকে উদ্দেশ করে বলতে থাকেন, ‘জেলে তাঁকে যেতেই হবে। এই এখলাছ, তুমি ইকবালকে জানাও।’
এখলাছ হচ্ছেন অর্থ বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব এখলাছুর রহমান, যিনি কোম্পানিটির পর্ষদে ছিলেন। আর ইকবাল হচ্ছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎকালীন পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হাসান। দুজনেই ইতিমধ্যে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।
রউফ তালুকদারের কথা শুনে এখলাছুর রহমান তখন সৈয়দ ইকবাল হাসানকে কী বলেছিলেন বা আদৌ কিছু বলেছিলেন কি না, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে দুদকে একটি মামলা হয়েছিল ফরমানুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ফরমানুল ইসলাম আজ রোববার প্রথম আলোকে জানান, তাঁকে জেলে যেতে হয়নি।
এ ঘটনা তুলে ধরে বিআইএফএফএলের সাবেক সিইও ফরমানুল ইসলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। বল প্রয়োগ করে তাঁকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করানোর দায়ে মামলাটি করেন তিনি।
ফরমানুল ইসলাম আজ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের আদালতে মামলা করেন। মামলায় মোট ১২ জনকে আসামি করা হয়। মামলার আরও তিন গুরুত্বপূর্ণ আসামি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব সাজ্জাদুল হাসান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এবং বিআইএফএফএলের বর্তমান সিইও এস এম আনিসুজ্জামান। অন্যরা বিআইএফএফএলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা।
বল প্রয়োগে চাকরি থেকে পদত্যাগ করানোর পাশাপাশি প্রতারণা ও মানহানির অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআইকে) অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। এস এম ফরমানুল ইসলাম নিজেই এসব তথ্য জানিয়েছেন।
মামলায় ২০১৯ সালের ৮ জুলাই, ২৮ জুলাই, ৬ আগস্ট ও ৮ আগস্টের চারটি আলাদা ঘটনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে একটি ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সালমান এফ রহমানের তিস্তা সোলার প্রকল্পে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব দিতে বলেন। কোম্পানির পলিসি অনুযায়ী তা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানালে রউফ তালুকদার বাদীর ওপর খেপে যান।
এরপর সেই প্রকল্পের অনুকূলে ২০০ কোটি টাকার জিরো কুপন বন্ডে বিনিয়োগের জন্য চাপ দেন তাঁরা। সেই টাকা আগাম ঋণ চাইলে বাদী পর্যাপ্ত তহবিল নেই বলে জানান। ফরমানুল ইসলামকে উদ্দেশ করে রউফ তালুকদার বলেন, ‘আপনি প্রস্তাব দেন, বাকিটা আমি দেখব।’ রাজি না হওয়ায় আবারও বাদীর ওপর ক্ষিপ্ত হন রউফ তালুকদার।
অভিযোগে বলা হয়, পর্যায়ক্রমে আরও অবৈধ সুবিধা চাইতে থাকেন তাঁরা। রাজি না হওয়ায় আসামিরা বাদীকে জোরপূর্বক চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এতে বাদীর অপূরণীয় আর্থিক ক্ষতি, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও মানহানি হয়েছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
যোগাযোগ করলে বিআইএফএফএলের সিইও এস এম আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এ মামলার কথা শুনে হতবাক হয়েছি। তিনি পদত্যাগ করার অনেক পরে আমি যোগ দিয়েছি। আমি কেন আসামি?’
এস এম আনিসুজ্জামান আরও বলেন, ‘ফরমানুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বিআইএফএফএল ২টি দুর্বল ব্যাংক ও ১১টি দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রাখে। এর বড় অংশ জমা আছে এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং বর্তমানে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা আটকে আছে। এ ছাড়া তাঁর সময়ে ইটভাটায় যত ঋণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর সবই এখন খেলাপি। দুদকের মামলার আসামি হয়ে তিনি এখন আমাদের বিরুদ্ধে কোন বিবেচনায় মামলা করতে এলেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়।’