অতিরিক্ত গতি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে এক্সপ্রেসওয়েতে। চালককে দক্ষ করে তোলার ওপর জোর।
দেশের একমাত্র এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। উদ্বোধনের এক বছরেই সড়কটিতে ২৬০টি দুর্ঘটনায় ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও মোটরসাইকেলের অনিয়মতান্ত্রিক চলাচলে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পুলিশের নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে বিআরটিএ। আর পুলিশ জোর দিচ্ছে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ওপর। সঙ্গে হাইওয়ে থানাগুলোতে জনবল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ সুযোগ–সুবিধা বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছে তারা।
সর্বশেষ গত শনিবার এক্সপ্রেসওয়ের মালিগ্রাম উড়ালসড়কে একটি অ্যাম্বুলেন্সের সামনের চাকা ফেটে মা, দুই মেয়ে, নাতি–নাতনিসহ এক পরিবারের সাতজন নিহত হন। নিহত হন অ্যাম্বুলেন্সের চালকও। এর আগে গত ১৯ মার্চ শিবচরে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে গেলে ১৯ জন নিহত হন।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কটির দৈর্ঘ্য ৫৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার এবং জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার। মাদারীপুর হাইওয়ে পুলিশ ও মুন্সিগঞ্জ সড়ক বিভাগের হিসাব বলছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর গত এক বছরে এক্সপ্রেসওয়েতে ২৬০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ৯৪ জন।
এর মধ্যে ঢাকা থেকে মাওয়া অংশে ২১১টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৬ জন। আর জাজিরা-ভাঙ্গা অংশে ৪৯টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৮ জন। দুর্ঘটনার সংখ্যা জাজিরা ভাঙ্গা অংশে কম হলেও এখানে মৃত্যু বেশি। এই ৬৮ জনের মধ্যে ৩৪ জনই মারা গেছেন চারটি বড় দুর্ঘটনায়।
এক্সপ্রেসওয়েতে এত দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক মো. সামছুল হক বলেন, দ্রুতগতির অবকাঠামো হলো। কিন্তু তার সঙ্গে দক্ষ ও যোগ্য চালক না হলে, গাড়ির ফিটনেস ঠিকঠাক না থাকলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সড়কসংকেত না মানলে এক্সপ্রেসওয়েতে বিপর্যয় ঘটবে।
বিপর্যয়রোধে করণীয় সম্পর্কে সামছুল হক বলেন, চালকের যোগ্যতা যাচাই করতে হবে এবং ফিটনেস দেওয়ার আগে গাড়িটা ঠিকঠাক যাচাই করা জরুরি।
মাদারীপুর হাইওয়ে সূত্রে জানা গেছে, গত জুন থেকে চলতি জুন পর্যন্ত এই হাইওয়ের অধীনে ৩৯ হাজার ৪১৭টি মামলায় মোট ১৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ গতির সব মামলা হয়েছে জাজিরা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অংশে। এর সংখ্যা ১৩ হাজার ৮৮৭টি।
হাইওয়েতে দুর্ঘটনারোধে মূল কাজ হাইওয়ে পুলিশের উল্লেখ করে ফরিদপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মো. ইমরান খান বলেন, পুলিশের নজরদারি বাড়ালে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। মোটরসাইকেলের জন্য দুর্ঘটনা বাড়ছে। এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল চলতে দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি।
সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের ওপর জোর দিয়েছেন হাইওয়ে মাদারীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার মাহবুবুল আলম। পাশাপাশি হাইওয়ে থানাগুলোতে জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। সবার সম্মিলিত চেষ্টা ছাড়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয় বলে মত দেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
কোনো গাড়ি যখন দুর্ঘটনায় পড়ে, তখন বিআরটিএ কিংবা হাইওয়ে পুলিশ নিজেদের দোষ ঢাকতে ‘দ্রুত গতির’ কথা বলে দায় তাঁদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের জাকির। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণের ২১টি জেলায় যে সংখ্যক গাড়ি চলাচল করছে, তার ৯৫ ভাগের রুট পারমিট নেই। ওই গাড়িগুলো সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ‘ম্যানেজ’ করে অবৈধভাবে চলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় প্রায় নিয়মিত যাতায়াত করেন ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুর মহল্লার শাহীন আহমেদ। তিনি বলেন, সবাই গতির সঙ্গে থাকতে চায়, কেউ পিছিয়ে পড়তে চান না। কোনো গাড়ি ওভারটেক করলে যাত্রীরা হইচই জুড়ে দেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ড্রাইভার কী গাড়ি চালায়!’ আবার দ্রুত চালালে বলে ‘মাতালের মতো গাড়ি চালাচ্ছেন কেন?’ সব মিলিয়ে একটি ভজকট অবস্থার সৃষ্টি হয়। যে কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
বিআরটিএ ও পুলিশ—দুই পক্ষেরই নজরদারি জরুরি উল্লেখ করেন ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সভাপতি আওলাদ হোসেন বলেন, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং মোটরসাইকেল চলার জন্য দুর্ঘটনা বাড়ছে। পরিবহনমালিকেরা লাইসেন্সবিহীন চালকদের বেশি পছন্দ করেন। কারণ, তাঁদের জন্য জরিমানা কম দিতে হয়। পাশাপাশি আট ঘণ্টার জায়গায় দিনে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত গাড়ি চালাতে বাধ্য করা হয় তাঁদের। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে পর্যবেক্ষণ, জরিমানার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
এক্সপ্রেসওয়েটির দেখভালের দায়িত্ব মুন্সিগঞ্জ সড়ক বিভাগের। মুন্সিগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিন রেজা বলেন, অতিরিক্ত গতির পাশাপাশি টায়ারের টেম্পার না থাকায় টায়ার ফেটে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এ পথে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার।
কিন্তু গাড়িগুলো চলছে ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে। এ অবস্থায় চাকা ফেটে যাওয়া কিংবা কোনো আঘাতের কারণে ব্রেক চেপে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে।
নাহিন রেজা আরও বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা–মাওয়া অংশে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। পরে জাজিরা–ভাঙ্গা অংশে কাজ শুরু হবে। সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো সম্পূর্ণ হলে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।