উন্নয়ন সহযোগীদের জন্য ৫ দফা সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর

0
160
এলডিসি ৫ জাতিসংঘ সম্মেলনে ৫ দফা সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের মতো উত্তরণের পথে অগ্রসর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অগ্রাধিকারমূলক বাজারে প্রবেশাধিকার কমপক্ষে ছয় বছর বাড়ানোর পক্ষে সমর্থন কামনা করেছেন। তিনি এলডিসি ৫ জাতিসংঘ সম্মেলনের সাইডলাইনে এক অনুষ্ঠানে উন্নয়ন সহযোগীদের সামনে পাঁচ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আমাদের উন্নয়ন অংশীদারদের জন্য পাঁচটি পরামর্শ তুলে ধরতে চাই। প্রথমত বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য কমপক্ষে ছয় বছরের জন্য অগ্রাধিকারমূলক বাজারে প্রবেশাধিকার সম্প্রসারণ; বাণিজ্যের জন্য সহায়তাসহ তাদের বাণিজ্য সুবিধা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রদান করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী কাতার ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে (কিউএনসিসি) আয়োজিত ‘গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর স্মুথ অ্যান্ড সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন: মার্চিং টুওয়ার্ডস স্মার্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় পরামর্শে তিনি বেসরকারি খাতে প্রণোদনার মাধ্যমে উত্তরণের পথে অগ্রসর স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এফডিআই প্রবাহ বাড়ানো এবং পারস্পরিক কল্যাণমূলক বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি হালনাগাদ করার আহ্বান জানান।

তৃতীয়ত, তিনি শিল্প সম্পর্ক উন্নত করা এবং ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে দক্ষ সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য বেসরকারি খাতকে সহায়তা করার উপায় অনুসন্ধানসহ উত্তরণের পথে অগ্রসর স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে টেকসই শিল্প প্রবৃদ্ধি জোরদারের আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর চতুর্থ পরামর্শে বলেন, ‘উদ্ভাবনী অর্থায়নের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যাতে উত্তরণ পর্বে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ঋণের খরচ সহনশীল থাকে।’ পঞ্চম সুপারিশে তিনি এলডিসি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভৌত ও ডিজিটাল অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের ওপর জোর দেন; এবং মানব পুঁজি গঠন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে তাদের অব্যাহত বিনিয়োগ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের উত্তরণের পথে অগ্রসর হওয়ার সময়, আমরা জানি আমরা কোথায় যেতে চাই এবং কিভাবে সেখানে যেতে হবে। আমাদের সরকার বাংলাদেশকে উত্তরণের পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যেতে দেবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তরণের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য, আমাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বন্ধুদের কাছ থেকে নিশ্চিত সমর্থন প্রয়োজন। বিগত ৫১ বছরে বাংলাদেশের ট্র্যাক রেকর্ড প্রমাণ করে যে, দেশটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতি ন্যায্য আচরণ করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম এলডিসি অর্থনীতি হিসেবে, আমরা একটি সাবলীল উত্তরণের ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশগুলিকে উত্তরণের পথ বেছে নিতে উৎসাহিত করার আশা রাখি।’

শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশ জাতিসংঘের তিনটি মানদণ্ডে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। ২০১৫ সালে, বাংলদেশ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ তার আগে ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচকের মধ্যম বন্ধনীতে স্থান পেয়েছে। এমডিজি অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে একটি মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ও জনগণ ২০২৬ সালে বাংলাদেশের মসৃন ও টেকসই এলডিসি উত্তরণের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অপেক্ষায় রয়েছি। আমাদের বেসরকারি খাত এবং সামাজিক অংশীদারদের এই যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।’ তিনি এসডিজি অর্জনসহ এই গতি বজায় রাখার আশা প্রকাশ করেন।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য, আমাদের উত্তরণ লাভের বাইরেও এলডিসিগুলির জন্য কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তা ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশকে এর উৎপাদনশীল সক্ষমতা আরও গড়ে তুলতে হবে এবং এর উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনতে হবে। কারণ, আমাদেরকে অবশ্যই কম কার্বন অনুকূল প্রবৃদ্ধির পথ অনুসরণ করতে হবে। আমরা যথাযথ পদক্ষেপ মেনে চলার আশা করি। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের অবশ্যই ডিজিটালাইজেশন এবং উদ্ভাবন করতে হবে। আমরা আমাদের জনগণের উন্নয়নের অধিকার সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, আমরা তা করতে পারি। কোভিড-১৯ মহামারী প্রাদুর্ভাবের ঠিক আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। দেশে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে জনগণের গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে এবং সাক্ষরতার হার এখন ৭৫.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। স্কুলগুলোতে বালক-বালিকার হারে সমতা অর্জিত হয়েছে এবং দেশের নারী ও মেয়েরা সমাজের সব অংশে তাদের সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। আমাদের দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং জলবায়ু অভিযোজন প্রায়ই উদাহরণ হিসাবে নেওয়া হয়। সরকার “আমার গ্রাম, আমার শহর” কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় শহুরে সুবিধাগুলি নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি তাঁর দেশবাসীকে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য প্রতি ইঞ্চি জমি চাষ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রামীণ জনগণের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা সহায়তা, পাবলিক সার্ভিসের ডিজিটাইজেশন, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল এবং হাই-টেক পার্কের ক্ষেত্রে তার সরকারের সাফল্য এবং অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখি আমাদেও ছেলে-মেয়েরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস এবং রোবোটিক্সে নেতৃত্ব দেবে। সরকার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে একটি উদ্ভাবনী প্রতিবেশ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জোর দিচ্ছে। আমরা আমাদের ঐতিহ্যগত জ্ঞান, জেনেটিক সম্পদ এবং সুনীল অর্থনীতির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাই।’

সরকারপ্রধান আরও বলেন, ‘ব্যবসা করার ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিগগিরই একটি লজিস্টিক নীতিমালা তৈরি করবে। আমরা দূষণমুক্ত জ্বালানিসহ একটি মিশ্র জ্বালানি ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করছি। বাংলাদেশও সাধ্যমত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। আমরা দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার আওতায় অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সাথে আমাদের ই-গভর্নেন্স টুল শেয়ার করছি। অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের ভালো চর্চা শেয়ার করার জন্য ঢাকায় একটি আঞ্চলিক জলবায়ু অভিযোজন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের এনজিওগুলো দেশের উন্নয়নের মডেল বিশ্বের অন্যান্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে আমাদের কৃষি অভিজ্ঞতার ভাল অনুশীলনগুলো বিনিময় করার প্রস্তাব দিয়েছি। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ মানবিক জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দিচ্ছে।’

ডেনমার্কের উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী ড্যান জোগেনসেন এবং ডব্লিউটিও, ওইসিডি, ইউনিডো এবং আঙ্কটাডসহ বিভিন্ন সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত সাইড ইভেন্টে প্যানেলিস্ট হিসেবে বক্তব্য দেন। জেনেভায় জাতিসংঘ কার্যালয়ে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য রাখেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য রাখেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.