বীমা খাতের উন্নয়নে ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ১ মার্চ জাতীয়ভাবে বীমা দিবস পালন হচ্ছে। এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য কি?
শেখ কবির হোসেন: বীমা বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা বীমা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে বীমা খাত ব্যাপক অবদান রাখছে। এসব দেশ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষত অবকাঠামো উন্নয়নে লাইফ ফান্ডের ওপর নির্ভর করে। কারণ অন্য উৎসের তুলনায় লাইফ ফান্ড থেকে তুলনামূলক বেশি দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সংগ্রহ করা যায়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। একদিকে জনসাধারণের মধ্যে বীমা পলিসি নিয়ে আগ্রহ কম, অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ে আগে এ খাত যথেষ্ট গুরুত্ব পেত না। সব দিক চিন্তা করে জাতীয়ভাবে বীমা দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
জাতীয়ভাবে ১ মার্চকে কেন বীমা দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে?
শেখ কবির হোসেন: এর একটি ঐতিহাসিক দিক রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চ তৎকালীন আলফা ইন্স্যুরেন্সে বীমা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। মূলত চাকরি করার উদ্দেশ্যে নয়, নির্বিঘ্নে রাজনীতি চালিয়ে নিতেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। যদিও কোম্পানিটি চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মতো জনপ্রিয় নেতাকে সামনে রেখে ব্যবসা করা। তাতে বঙ্গবন্ধুর অবশ্য আপত্তি ছিল না। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশব্যাপী কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। এ চাকরির আড়ালে ঐতিহাসিক ছয় দফার প্রচারের কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বীমা কর্মকর্তা হিসেবে দেশের যে কোনো প্রান্তে যেতে পারতেন। আলফা ইন্স্যুরেন্সের অফিস ছিল ঢাকার গুলিস্তানের তৎকালীন জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে, যা এখন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। ওই অফিসে গিয়ে তাঁকে রাজনীতি নিয়ে কাজ করতে দেখেছি। রাজনীতির কর্মীরাও ওই অফিসে গিয়ে সহজে কথা বলতে ও বৈঠক করতে পারতেন। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের এ ঐতিহাসিক দিক স্মরণীয় করে রাখতে ১ মার্চ জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
আপনি বীমা কোম্পানিগুলোর সংগঠন বিআইএর সভাপতি। বাংলাদেশের বীমা খাত নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
শেখ কবির হোসেন: দেশের অর্থনীতির আকার বা এর যে অগ্রগতি হচ্ছে, তার তুলনায় বীমা খাত অনেক পিছিয়ে আছে। এর বড় কারণ, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এ খাতের উন্নয়ন থামিয়ে দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু দ্রুততম যেসব পদক্ষেপ নেন, তার মধ্যে বীমা খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অন্যতম ছিল। বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি ছিল, এ খাতের উন্নয়ন হলে দেশও উন্নত হবে। এ কারণে ১৯৭২ সালে অধ্যাদেশ জারি করে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। পরবর্তী স্বৈরাচারী সরকারগুলো তিলে তিলে এ খাত ধংস করেছে। এ খাতে দুর্নীতি ও নানা জঞ্জাল ঢুকেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাকে বীমা খাতে তার পিতার অবদান বিষয়ে জানাই। এর পর প্রধানমন্ত্রী এ খাতের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। ২০১০ সালে আইন করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) গঠন করেছেন। বীমা খাতের উন্নয়ন যা হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের শাসনকালেই হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে বীমা নিয়ে সচেতনতা ও আস্থা বাড়ছে। আগে বীমা খাত নিয়ে অনেক অনিয়মের কথা শোনা যেত, প্রিমিয়াম দিয়েও মানুষ বীমা দাবির জন্য ঘুরতে হতো। এখন এমন অভিযোগ কমেছে।
সময়মতো বীমা দাবি পরিশোধ করছে না, এমন অভিযোগ কিছু বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে…
শেখ কবির হোসেন: এমন অভিযোগ একেবারে নেই, তা বলা যাবে না। অভিযোগ এখনও আছে, তবে আগের তুলনায় অনেক কমেছে। ২০২২ সালে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে ১৩ হাজার ৮২৬ কোটি টাকার বীমা দাবি ছিল। এর বিপরীতে ৯ হাজার ২৫৯ কোটি টাকার দাবি পরিশোধ করা হয়েছে। সাধারণ বীমায় ২ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা বীমা দাবির বিপরীতে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিশোধ হয়েছে। অনেক কোম্পানি এক সপ্তাহের মধ্যে বীমা দাবি পরিশোধ করছে। বীমা দিবসে শত শত কোটি টাকার বীমা দাবি পরিশোধ হচ্ছে। এগুলো স্বীকার করতে হবে।
অভিযোগ আছে, কিছু কোম্পানি তাদের প্রকৃত দাবি বিষয়ে তথ্য দেয় না। আগের বছরগুলোরও বীমা দাবিও অপরিশোধিত আছে…
শেখ কবির হোসেন: আগের পরিসংখ্যান আরও খারাপ ছিল। অনেক কোম্পানি মানুষের বীমার টাকার সদ্বব্যবহার করেনি। ফলে তাদের বীমা দাবি পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে। একটি জীবন বীমা কোম্পানিকে তাদের স্থায়ী সম্পদ বিক্রি করে বীমা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ এ বিষয়ে আগের থেকে কঠোর এবং নজরদারি বাড়িয়েছে। ফলে উন্নতি হচ্ছে। বর্তমানে জীবন বীমা খাতে ৩৫টি এবং সাধারণ বীমা খাতে ৪৬টি কোম্পানি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে কিছু কোম্পানি বিষয়ে অভিযোগ থাকা অস্বাভাবিক নয়।
সময়মতো বীমা দাবি পরিশোধ হলে মানুষের মধ্যে আস্থা বাড়ে। এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
শেখ কবির হোসেন: এ সমস্যা একদিনে তৈরি হয়নি। সব ঠিক করতে সময় লাগবে। বর্তমান সরকার নজর দেওয়ার ফলে কোম্পানিগুলো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা প্রচলন করেছে। আগে বীমা এজেন্টরা বীমার প্রিমিয়াম সংগ্রহ করত। তাদের অনেকে এ টাকা কোম্পানিতে জমা করতো না। প্রথম প্রিমিয়ামের পর এজেন্ট কমিশন পেতো না বলে পরবর্তি প্রিমিয়াম জমা করতে বীমা এজেন্টরা কাজ করত না। এটি বন্ধ করতে কমিশন একাধিক দফায় দেওয়ার ব্যবস্থা আনা হয়েছে। প্রস্তাব করা হয়েছে, প্রথম প্রিমিয়াম থেকে এজেন্ট টাকা পাবেন না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রিমিয়াম থেকে কমিশন পাবেন। এর ফলে বীমা তামাদি হওয়ার হার কমবে। তাছাড়া এজেন্টদের টাকা মেরে দেওয়া ঠেকাতে ব্যাংকে বা মোবাইল মানি ট্রান্সফার প্রক্রিয়ায় প্রিমিয়াম পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণ বীমায় কমিশন প্রথা বন্ধ করা হয়েছে। এভাবে অনিয়ম বন্ধ করা হচ্ছে।
সরকার বীমা খাতের উন্নয়নে আগ্রহী। তারপরও কোনো চ্যালেঞ্জ কী কিছু দেখছেন?
শেখ কবির হোসেন: কিছু চ্যালেঞ্জ তো আছেই। যেসব কোম্পানি এরই মধ্যে মানুষের প্রিমিয়ামের অর্থ নষ্ট করেছে, বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না, তাদের জন্য পুরো বীমা খাত নিয়ে মানুষের মধ্যে অনাস্থা কাজ করছে। এটি সহজে দূর করা যাচ্ছে না। আবার এর সহজ সমাধানও নেই। অন্যদিকে সরকারের অনেক পরিকল্পনা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা সত্ত্বেও অনেক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হচ্ছে না বা ধীর গতি দেখা যাচ্ছে। আইডিআরএ প্রতিষ্ঠা হয়েছে ২০১১ সালে। কিন্তু এর স্থায়ী জনবল নিয়োগ হয়েছে সম্প্রতি। এভাবে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না– যা একটা চ্যালেঞ্জ।