উদ্যোক্তা থেকে যেভাবে দেশের প্রথম সফল নারী অ্যাগ্রো–ইনফ্লুয়েন্সার হলেন পপি

0
14
ভিডিওর কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুপরিচিত মুখ উম্মে কুলসুম পপি, ছবি: সংগৃহীত

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েই আবু সাঈদ আল সাগরের সঙ্গে লালমনিরহাটের উম্মে কুলসুম পপির পরিচয়। ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেন পপি আর সাগর ছিলেন পরিসংখ্যানের ছাত্র। কয়েক বন্ধু মিলে ‘ক্রিয়েটিভ সোসাইটি’ নামে একটা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সাগর। উপস্থাপনা শেখার পাশাপাশি সেখানে গ্রাফিক ডিজাইন এবং ভিডিও এডিটিংয়ের কাজ শিখতেন তাঁরা। পপিও সেখানে যোগ দিলেন। এই প্ল্যাটফর্মই পরে ২০১৬ সালে ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট লিমিটেড’ নামে একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগে রূপ বদল করে। মাঝপথে পড়াশোনা থেমে গেছে, এমন তরুণদের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি সারাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে কাজের অর্ডার নেওয়া হতো। এই তরুণেরা দিতেন হোম সার্ভিস।

ক্যাম্পাসের বাইরে অফিস নেওয়া হলো। এ সময় তাঁদের একটি বিজনেস আইডিয়া পুরস্কার পেল। মুম্বাই যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। কিন্তু বাড়ি থেকে পপিকে যেতে দিল না। একাই গেলেন সাগর। একসময় পপি ও সাগরের মনে হলো, তাঁদের দুজনের ভাবনা ও স্বপ্নের ঠিকানা যেহেতু কাছাকাছি, তাই সম্পর্কটাকে পাকাপাকি করা দরকার। বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন তাঁরা। এবার আর কোথাও যেতে বাধা নেই।

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েই আবু সাঈদ আল সাগরের সঙ্গে উম্মে কুলসুম পপির পরিচয়, ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু ২০২০ সালে করোনায় বড় একটা ধাক্কা খেল বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট। হোম সার্ভিস নিতে কেউ আর তাঁদের ডাকে না। শুরুর সময় থেকে যাঁরা সঙ্গে ছিলেন, ভালো ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে তাঁদের অনেকেই ধীরে ধীরে সরে গেলেন। পপি ও সাগর কিন্তু তখনো তাঁদের সংকল্পে অটল, চাকরি করবেন না, চাকরি দেবেন।

এই করোনাই আবার অন্যভাবে সুযোগ সৃষ্টি করে দিল। ২০২০ সালে করোনার বছর সরবরাহ করতে না পেরে রংপুরে প্রচুর আম নষ্ট হচ্ছিল। পরিবহন চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছিল। মানুষও বাইরে গিয়ে কিনতে ভয় পাচ্ছিল। এ ব্যাপারটি কাজে লাগালেন পপি ও সাগর। রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙা আম দিয়ে শুরুটা করলেন। কুরিয়ারে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ শুরু করলেন। নবীন উদ্যোগটার নাম দিলেন প্রিমিয়াম ফ্রুটস। রংপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরার চাষিদের কাছ আম সংগ্রহ করে বাগান থেকেই গ্রাহকদের কাছে পাঠানো শুরু হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালালেন। নিজেদের পরিচিতজনদের বললেন। ভালো সাড়া পাওয়া গেল।

ফল পাড়ার কমপক্ষে প্রায় ১০-১৫ দিন আগে থেকেই কোনো বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করা হবে না, এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করলেন তাঁরা। অগ্রিম ক্রয় চুক্তির মাধ্যমে প্রায় এক বছর আগেই বাগানীদের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতিতে শুরু হলো কাজ। ২০২২ সালের শুরুতে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করল প্রিমিয়াম ফ্রুটস লিমিটেড।

আর এখান থেকেই পপির ভিডিও কনটেন্ট বানানোর গল্পের শুরু।

পপি যেভাবে অ্যাগ্রো–ইনফ্লয়েন্সার

২০২০ সাল থেকেই নিজের আগ্রহে, আবার কখনো ব্যবসার প্রয়োজনে পপিকে কখনো পেয়ারাবাগানে, কখনো বরইবাগানে, কখনো কৃষি খামারে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। সে সময় কৃষক-বাগানিদের কাছ থেকে হাত কলমে অনেক কিছু শিখেছেন। পাশাপাশি কৃষকদের নানা সমস্যাও তাঁকে ভাবাত। তাই কৃষি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির কৃষি বইগুলো আবার পড়লেন। একসময় তাঁর মনে হলো, শেখার বিষয়গুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। সে ভাবনা থেকেই ভিডিও বানানো শুরু। পপি প্রথম ভিডিওটি বানিয়েছিলেন তিস্তার একটি চরে। সেটা ছিল ২০২২ সাল। সেখানে তিনি কুমড়ার চাষ নিয়ে কথা বলেছিলেন। সাড়া পেয়েছিলেন আশাতীত। নিমপাতা ব্যবহার করে জৈব কীটনাশক তৈরির একটি ভিডিও বানিয়েছিলেন। এটা দেখে অনেকেই পরে নিমপাতা দিয়ে জৈব কীটনাশক তৈরি করে ব্যবহার করেছেন। এ রকম আরও কত ভিডিও। সেসব ভিডিওর কোনোটায় ভোরবেলা খেত থেকে কেটে আনেন কচি লাউ, কখনো বলতে থাকেন লালশাকের গুণাগুণ, আবার কখনো গ্রাম্য বধূর মতো কুলায় চাল ঝাড়তে বসেন। যতটা সম্ভব সহজভাবে বক্তব্য উপস্থাপনের চেষ্টা করেন পপি, সবাই যাতে বুঝতে পারেন। এসব ভিডিওর কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুপরিচিত এক মুখ এখন উম্মে কুলসুম পপি।

ভিডিওর কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুপরিচিত মুখ উম্মে কুলসুম পপি, ছবি: সংগৃহীত

পপিকে বলা যায় দেশের প্রথম সফল নারী অ্যাগ্রো–ইনফ্লুয়েন্সার। একটু পরিসংখ্যান হাজির করলেই বোঝা যাবে মাত্র দুই বছরেই কতটা ভালোবাসা পেয়েছেন এই নারী। তাঁর ফেসবুক পেজে অনুসারী ২৪ লাখের বেশি। ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার চার লাখ ছাড়িয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ সংখ্যাটিও বাড়ছে ধাই ধাই করে।

উম্মে কুলসুম পপি প্রিমিয়াম ফ্রুটসের চেয়ারম্যান আর আবু সাঈদ আল সাগর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

ফলের পাশাপাশি নিরাপদ সবজি, নিরাপদ প্রক্রিয়াজাত খাবার নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনাও তাঁদের রয়েছে। তাঁদের চিন্তায় অ্যাগ্রিট্যুরিজমের বিষয়টিও রয়েছে। রংপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে তাঁদের নিজস্ব কৃষি প্রকল্পে সবজি ও ফলের গাছ বড় হচ্ছে, আছে মাছের পুকুর। পর্যটকেরা সেখানে গিয়ে নিজ হাতে ফল পেড়ে খেতে পারবে। বিষমুক্ত সবজি রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থাও থাকবে। পুকুরে মাছ ধরতে পারবে। গরু থাকবে, খাওয়া যাবে খাঁটি দুধ। সেখানে এক দিন-দুই দিন বেড়ানোর ব্যবস্থাও থাকবে।

পপির ভাষায়, তাঁর ভিডিও কনটেন্ট তৈরি ও ব্যবসা একসূত্রে গাঁথা। কৃষিকাজ করলে কে কী ভাববে, এমন দ্বিধা কখনো মনে স্থান দেননি। তাঁর মতে, সবচেয়ে সম্মানজনক পেশা হলো কৃষিকাজ। খামারের গাছগুলো তাঁর কাছে সন্তানের মতো। এই সন্তান ঠিকমতো খাবার (পানি) পেল কি না, চিন্তায় থাকেন সারাক্ষণ।

কাজী আলিম-উজ-জামান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.