সে সময় আক্কাম্মা প্রথম সন্তানের (কন্যা) জন্ম দেন। তিনি শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। তাঁর বাড়ির সামনেই ইয়েল্লাম্মার বাড়ি ছিল। ইয়েল্লাম্মার মা আক্কাম্মার শাশুড়ির সঙ্গে একই মাঠে কাজ করতেন। সন্তান জন্মের প্রায় পাঁচ মাস পর আক্কাম্মাকে ভূস্বামী ডেকে পাঠান। সে সময় তেলেগু ভাষায় ভূস্বামীকে ‘ডোরা’ বলা হতো। তেলেঙ্গানা অঞ্চলে ভূস্বামী বা জমিদাররা শূদ্র সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছিল। ঐতিহ্যগতভাবে এই সামন্ত জমিদাররা অনেক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। প্রতিটি গ্রামে একাধিক ডোরা পরিবার থাকত। এই ভূস্বামীরা বিশাল বাড়ি ও অনেক জমির মালিক ছিলেন। এসব জমিতে নিম্নবর্ণের মানুষ কাজ করতেন।
ডোরার ২০ বছর বয়সী স্ত্রীও কয়েক সপ্তাহ আগে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু সন্তান মায়ের বুকের দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে পেত না। এ কারণে সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য আক্কাম্মাকে ডেকে নিয়ে আসা হয়।
ইয়েল্লাম্মা বলেন, আক্কাম্মা নিজের সন্তানকে দিনে অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টার জন্য বাড়িতে রেখে যেতেন। বাড়ি ফেরার পরও মাঝেমধ্যে তাঁকে ডোরার বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হতো। এভাবে ডোরার সন্তানকে বেশি দুধ খাওয়ানোর কারণে তাঁর নিজের সন্তান পর্যাপ্ত দুধ পেত না, ক্ষুধার্ত থাকত।
বাধা দিলেই নির্যাতন
২০০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রচলিত পিতৃতন্ত্র, বর্ণপ্রথা ও কর্তৃত্বের কাঠামো দলিত নারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জমিদারের সন্তানকে নিজের বুকের দুধ খাওয়ানো ও গৃহশ্রম দিতে দলিত নারীদের বাধ্য করানো হতো। এ ছাড়া উচ্চবর্ণের পুরুষেরা দলিত নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নও চালাতেন।
ইয়েল্লাম্মা বলেন, ‘তাঁরা আমাদের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে ভাবতেন। আমাদের শরীরে যা কিছু আছে, এমনকি নিজের সন্তানের জন্য রাখা বুকের দুধও তাঁরা ইচ্ছামতো ব্যবহার করতেন।’ তিনি আরও বলেন, নারীরা এতে বাধা দিতে পারতেন না। বাধা দিলেই তাঁদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো।
২০০৬ সালে উচ্চবর্ণের সদস্যরা একটি দলিত পরিবারের জমি দখল করে নেন। দলিত পরিবারটি এর প্রতিবাদ করায় ওই পরিবারের মা ও মেয়েকে মহারাষ্ট্রের খাইরলাঞ্জি গ্রামে নগ্ন করে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং দুই ছেলেকেও নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। গত বছরের আগস্টেও শিক্ষকের মাটির পাত্র থেকে পানি খাওয়ার অপরাধে ৯ বছর বয়সী এক দলিত শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অন্যের শিশুকে নিজের বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রথা কবে থেকে শুরু হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণাও হয়নি এ নিয়ে। তবে দলিত সাহিত্যিকদের গল্প, উপন্যাস ও কবিতায় এ নিয়ে বিবরণ রয়েছে।
তবে দলিত সব নারীকেই যে এ কাজে বাধ্য করা হতো, তা নয়। নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যেও এ ঘটনা অহরহ ঘটত। আর নারীরা নিজ সম্প্রদায়ে এটা ইচ্ছা করেই করতেন।
ইয়েল্লাম্মা বলেন, নিজ সম্প্রদায়ে প্রসবের সময় যেসব মায়ের মৃত্যু হতো, ওই সন্তানদের স্বেচ্ছায় নিজের বুকের দুধ খাওয়াতেন অন্য নারীরা। দায়িত্ব ও স্নেহবোধ থেকেই নিজ সম্প্রদায়ে তাঁরা এটা করতেন। তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু ডোরাদের ক্ষেত্রে এমনটি হতো না। সেটা ছিল গোলামগিরি (দাসত্ব)।’
নিজের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোও ছিল নিষেধ
দোরনাকল গ্রামের ৮০ বছর বয়সী নরসাম্মাও (ছদ্মনাম) মাদিগা সম্প্রদায়ের সদস্য। তাঁরাই ছোটবেলায় কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন জাহ্নবী উপ্পুলেতিকে। জাহ্নবী তাঁর কাছে ‘উচ্চবর্ণের’ শিশুদের নিজের বুকের দুধ খাওয়ানো ও দেখভাল করার বিষয়ে জানতে চান।
নরসাম্মা বলেন, ‘তাঁরা আমাদের কেবল পণ্য ভাবতেন, যেন প্রয়োজনের সময় ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারেন। তাঁদের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো বা আমাদের ধর্ষণ করার সময় দলিত হিসেবে অস্পৃশ্যতায় তাঁরা বিরক্ত হননি।’
৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে নরসাম্মা ডোরাদের মালিকানাধীন লাল মরিচের খেতে কাজ করেছেন। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে তিনি ডোরার গোয়ালঘর পরিচ্ছন্নতার কাজও করেছেন। যখন তাঁর বয়স ২০ বছরের মাঝামাঝি, তখন তিনিও ডোরার সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর কাজ করতেন।
‘তাঁদের (ডোরা) সন্তানকে খাওয়াতে যাওয়ার আগে তাঁরা আমাদের নিজেদের সন্তানকে খাওয়াতে নিষেধ করেছিলেন। শুরুতে তাঁরা এমনভাবে শারীরিক নির্যাতন করে ভয় দেখাতেন যে তা তাঁদের বাধ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। ডোরারা চাননি, নারী নিজের বুকের দুধ কোনো অস্পৃশ্য শিশুকে খাওয়ান’,—বলছিলেন নরসাম্মা।
৮০ বছর বয়সী এই নারী আরও বলেন, ‘নিজের সন্তানকে ক্ষুধার্ত রাখার কারণে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু উপায় ছিল না, এটাই কাজ ছিল। এ বাবদ আমাকে এক বস্তা শস্য বা ১০ থেকে ২০ পয়সা দেওয়া হতো। যখন আমি তাঁদের বাড়িতে পৌঁছাতাম, তখন একটুকরা সাবান দিয়ে গোয়ালঘরের কাছ থেকে গোসল করে যেতে বলতেন। এমন আচরণ কোনো মানুষ মানুষের সঙ্গে করে না। অথচ তাঁর সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য ঘরে নিজের সন্তানকে অনাহারে রেখে এসেছি। আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করাকে তাঁরা জন্মগত অধিকারের চেয়ে কম কিছু মনে করেননি।’
নির্যাতন ঘরে-বাইরে
সে সময় নরসাম্মার মতো নারীদের এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় ছিল না। তবে তাঁরা জানিয়েছেন, এখন সেসব দিনের কথা ভাবলে তাঁরা অপমানিত বোধ করেন।
হায়দরাবাদে দ্য টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সের স্কুল অব জেন্ডার স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক সৌজন্য তামালাপাকুলা ভারতীয় সমাজে দলিত নারীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, ভারতের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও বর্ণপ্রথা দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্যবাদী বর্ণের নারীদের ‘শুদ্ধ ও পবিত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আর দলিত নারীদের ‘বৈধ অধিকার’ হিসেবে শোষণ করেছে।
ভারতীয় সমাজে নারীরা পিতৃতন্ত্রের শিকার। তবে বর্ণপ্রথা দেশটিতে উঁচু বর্ণের নারীদের জন্য বিশেষাধিকার নিশ্চিত করেছে। দলিত নারীবাদী ও শিক্ষাবিদদের মতে, ‘নিম্নবর্ণের’ নারীদের এই সুবিধাভোগী উচ্চবর্ণের নারীদের মাতৃত্ব ও পরিবারের দায়িত্বের বোঝা কমানোর জন্য ব্যবহার করা হতো।
নরসাম্মাসহ অন্য দলিত নারীরা উচ্চবর্ণের পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের দ্বারাও নিপীড়িত হতেন। নরসাম্মা বলেন, ‘তাঁরাও কি নারী নন? তাঁরা নিজেরাও তো মা হয়েছেন। তাঁদেরও জানা উচিত ছিল যে আমাদের পরিবারের যত্ন নিতে না পারার কষ্ট কত!’
দলিত নারীরা উঁচু বর্ণের পরিবারে কাজ করায় তাঁদের পরিবারের ধারণা ছিল, তাঁরাও এ থেকে আয় করে পরিবারে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু তা করতে না পারায় স্বামীর দ্বারাও তাঁরা নির্যাতনের শিকার হতেন।
ছোটদের কাঁধে বড় দায়িত্ব
একই গ্রামের ৫০ বছর বয়সী নারী সিরিশা (ছদ্মনাম)। নরসাম্মার কথা শেষ হলে তিনি বলেন, ‘আমার প্রয়াত মা উচ্চবর্ণের ডোরা পরিবারের শিশুকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াতেন। আমার ছোট ভাইবোনের জন্মের মাত্র কয়েক দিন পর তাদের ছেড়ে অন্যের বাড়িতে চলে যাওয়া প্রত্যেকের জন্য কষ্টকর ছিল। মা প্রতিদিন খুব ক্লান্ত থাকতেন। নিজের সন্তানকে ঠিকমতো দেখভাল করতে পারতেন না। ’
ডোরার বাড়িতে দলিত নারীদের সন্তানকে নিয়ে যাওয়া নিষেধ ছিল। তাই সন্তানকে নিজের বাড়িতে ছোট্ট কোনো মেয়ের তত্ত্বাবধানে রেখে নারীদের ডোরার বাড়িতে যেতে হতো। সিরিশা বলেন, ১৯৭০ সালের শেষের দিকে যখন তাঁর বয়স মাত্র ছয় বছর, তখন তাঁর ভাইবোনের জন্ম হয়। মা ডোরার বাড়িতে যেতেন বলে অতটুকু বয়সেই ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তাঁর। তিনি আরও বলেন, ‘ওই অতটুকু বয়সে কীভাবে নবজাতক শিশুর যত্ন নিয়েছি, তা ভাবলে আমি এখনো বিস্মিত হই।’
নরসাম্মা বলেন, ‘সবার ধারণা ছিল, আমাদের নারীদের বুকের দুধ পুষ্টিকর। তারা (উচ্চবর্ণ) আমাদের অপবিত্র ও নোংরা বলে অপমান করেছে, কিন্তু তারা আমাদের বুকের দুধ তাদের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য চেয়েছে। তারা বলেছে, তাদের শ্বাস নেওয়া বাতাস আমরা দূষিত করেছি, অথচ তারা আমাদের শরীর তাদের শিশুদের সংস্পর্শে আসুক তা চেয়েছে।’
হৃদয়বিদারক
অন্ধ্রপ্রদেশের লেখক ৪৯ বছর বয়সী ভূস্বামী পরিবারের সিন্ধু মাধুরী বেড়ে উঠেছেন কর্ণাটক রাজ্যের একটি গ্রামে। টেলিফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘মাদিগারা আমাদের গোয়ালঘরে কাজ করত। আমাদের বাড়িতে যা ঘটত, তার সবই তারা জানত।’ তাঁদের বাড়িতে সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর দায়িত্বে কেউ ছিলেন না। তবে অন্যদের বাড়িতে এমনটা হতো বলে জানিয়েছেন তিনি।
সিন্ধু মাধুরী বলেন, তাঁর বাড়িতে থাকা নারী ও মাদিগা নারীরা সহজভাবেই মিশেছেন। আর যেকোনো শোষণ পুরুষেরা করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘যখন নারীরা অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে চাইতেন না বা যৌনতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতেন, তখন তাঁরা কাজ হারাতেন। অন্য কোনো ভূস্বামীও তাঁদের আর নিয়োগ দিতেন না। এটি নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ঘটত।’
বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজের জন্য এভাবে মাদিগা নারীদের ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। তবে কখনো কখনো কেউ ভূস্বামীদের পরিবারের প্রতি ভালোবাসার কারণেও কাজ করেছেন বলে সিন্ধু মাধুরী বিশ্বাস করেন।
মাদিগা নারীদের নির্যাতনের জন্য তাঁদের সম্প্রদায়ের পুরুষেরা দায়ী কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সিন্ধু মাধুরী বলেন, ভারতের সব নারী পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার শিকার। ‘উচ্চবর্ণের’ নারীরাও এই পুরুষদের নির্যাতনের শিকার হন।