পুড়ে যাওয়া একটি লরি, কাঁদানে গ্যাসের খালি শেল ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পোস্টার—সবকিছু ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। ইমরানের স্ত্রী বুশরা বিবির নেতৃত্বে হওয়া বিশাল বিক্ষোভের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে এই জিনিসগুলো। এই সেই বিক্ষোভ, যা কয়েক দিন আগে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদকে পুরো অচল করে দিয়েছিল।
গত মঙ্গলবার বুশরা বিবি ডি চক এলাকার বিক্ষোভস্থলে একটি শিপিং কনটেইনারের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন। বুশরার গায়ে কালো রঙের বোরকার ওপর সাদা রঙের একটি চাদর জড়ানো ছিল। তাঁর মুখ ছিল সাদা নেকাবে ঢাকা। বুশরা যখন ওই এলাকায় পৌঁছান, তখন তাঁর স্বামীর হাজার অনুসারী রাস্তায় দাঁড়িয়ে পতাকা ওড়াচ্ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন।
মঙ্গলবার বিকেলে কাঁদতে কাঁদতে বুশরা বলছিলেন, ‘আমার সন্তানেরা এবং আমার ভাইয়েরা! আপনাদের আমার পাশে দাঁড়াতে হবে। এমনকি আপনারা যদি না–ও থাকেন, তারপরও আমি দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকব। এটা শুধু আমার স্বামীর বিষয়ই নয়, এটা এ দেশের বিষয় এবং এ দেশের নেতার বিষয়।’
পাকিস্তানি রাজনীতির দিকে নজর রাখেন, এমন মানুষেরা বলছেন এর মধ্য দিয়ে বুশরার রাজনৈতিক অভিষেক ঘটেছে। তবে পরদিন বুধবার সূর্যের আলো ফুটতে না ফুটতে বুশরার কোনো চিহ্নই দেখা গেল না। ইমরানের মুক্তির দাবিতে রাজধানী ইসলামাবাদ শহরের প্রাণকেন্দ্র বলে বিবেচিত ডি চকে বিক্ষোভে নামা হাজার হাজার মানুষের কাউকেই সেখানে দেখা গেল না।
কিন্তু শহরটি অন্ধকারে ঢেকে যাওয়ার পর সে বিক্ষোভ ও বুশরা বিবির কী হলো, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী সামিয়া (ছদ্মনাম) পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, হঠাৎই বাতিগুলো নিভে গিয়েছিল। ডি চক নামের ওই এলাকা তখন অন্ধকার হয়ে গেল। চারপাশে মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। কাঁদানে গ্যাসে জায়গাটি ছেয়ে গেল।
সামিয়া বলেন, এ সময় তাঁর স্বামীর কাঁধে গুলি লাগে। তিনি তাঁকে ধরে রেখেছিলেন। স্বামীর গায়ের রক্ত তাঁর হাতে লেগে ছিল। পরে ইসলামাবাদের একটি হাসপাতাল থেকে বিবিসি উর্দুকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রত্যেকে তাঁদের প্রাণ বাঁচাতে ছুটছিলেন। তাঁর মতে, পরিস্থিতি দেখে তখন যুদ্ধের মতো মনে হচ্ছিল। কিন্তু ঘটনা এত দ্রুত এমন পাল্টে গেল কেন?
ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বিক্ষোভকারীরা ডি চক এলাকায় পৌঁছেছিলেন। অনেক বাধা অতিক্রম করে সেখানে পৌঁছাতে পেরেছিলেন তাঁরা। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই ছিলেন ইমরানের নেতৃত্বাধীন দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) কর্মী ও সমর্থক।
ইমরান খান কারাগারে বসেই এ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন। বিভিন্ন অভিযোগে এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি কারাগারে। ইমরানের দাবি, অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইমরানের তৃতীয় স্ত্রী বুশরা বিবি। ২০১৮ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। তবে বুশরা মানুষের সামনে আসতেন না। অথচ এবারের বিক্ষোভে তিনিই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ডি চকে বুশরা ঘোষণা করেছিলেন, ‘খানকে (ইমরান) না নিয়ে আমরা ফিরব না।’
দলের ভেতরকার সূত্র বলেছে, বিক্ষোভের জন্য ওই স্থানকে বুশরা বিবিই বেছে নিয়েছিলেন। এ জায়গাতে একবার ইমরানও এক সফল বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তবে এবারের বিক্ষোভে ওই জায়গা বেছে নেওয়ার ব্যাপারে পিটিআই নেতারা বিরোধিতা করেছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকেও জমায়েতের জন্য অন্য জায়গা বেছে নিতে পিটিআইয়ের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তবে তা সত্ত্বেও ডি চকেই বিক্ষোভের ব্যাপারে অনড় ছিলেন বুশরা।
বুশরা বিবির এভাবে সামনে আসাটা বিস্ময়ের। কারণ, সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বুশরাকে সাধারণত অন্তরালে থাকা অরাজনৈতিক নারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর জীবনের শুরুর দিককার তথ্যগুলো অনেকটা অজানাই বলা চলে। শুধু এটুকু জানা গেছে যে ইমরান খানের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তিনি বিভিন্ন আধ্যাত্মিক উপদেশ দিতেন। তাঁর দেওয়া সুফি ঘরানার উপদেশগুলো ইমরান খানসহ অনেক অনুসারীকে আকৃষ্ট করত।
বুশরা কি তাহলে রাজনীতিতে নামছেন? নাকি কারাগারে থাকা ইমরানের দলকে চাঙা রাখার কৌশল হিসেবেই তিনি হঠাৎ সামনে এসেছেন। সমালোচকেরা বলছেন, পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিপক্ষে সোচ্চার থাকা ইমরানের অবস্থানের সঙ্গে বুশরার এ পদক্ষেপ সাংঘর্ষিক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাতি জ্বলার পর পুলিশ নতুন করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে।
এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এ অভিযান চলেছে। বিশৃঙ্খলার এক পর্যায়ে বুশরা বিবি ঘটনাস্থল থেকে চলে যান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, বুশরা বিবি গাড়ি বদল করে ঘটনাস্থল ছাড়ছেন। যদিও বিবিসি ওই ফুটেজের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। সেদিন বিক্ষোভস্থলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগেই অজ্ঞাত ব্যক্তিরা শিপিং কনটেইনারটি পুড়িয়ে দেন। কর্তৃপক্ষ বলেছে, ওই দিন দিবাগত রাত একটা নাগাদ সব বিক্ষোভকারী পালিয়েছেন।
আমিন খান নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, তিনিও সেদিনের সে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন। আমিন বলেন, ‘ইমরানকে নিয়ে ফিরবেন, নয়তো গুলি খাবেন’—এমন প্রস্তুতি নিয়েই তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার কথা অস্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, বিক্ষোভকারীদের কারও কারও কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে যাঁদের গুলিবিদ্ধ হিসেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নথিভুক্ত করেছে, সেসব নথি দেখতে পেয়েছে বিবিসি।
অবশ্য সরকারের মুখপাত্র আতাউল্লাহ তারার বিবিসিকে বলেছেন, গুলিবিদ্ধ হওয়া মানুষদের ভর্তি করতে এবং চিকিৎসা দিতে হাসপাতালগুলো অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিক্ষোভের সময় ঘটনাস্থলে নিযুক্ত থাকা সব নিরাপত্তাকর্মীকে তাজা গোলাবারুদ রাখতে নিষেধ করা হয়েছিল।
তবে চিকিৎসকদের একজন বিবিসি উর্দুকে বলেন, তিনি আগে কখনোই এক রাতে এতজন গুলিবিদ্ধ মানুষের অস্ত্রোপচার করেননি। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, কোনো কোনো রোগীর অবস্থা এত বেশি গুরুতর ছিল যে অ্যানেসথেসিয়ার জন্য অপেক্ষা না করে তখনই অস্ত্রোপচার শুরু করতে হয়েছিল।
সরকারিভাবে নিহত হওয়ার কোনো সংখ্যা জানানো হয়নি। তবে স্থানীয় হাসপাতালগুলোর সঙ্গে কথা বলে বিবিসি নিশ্চিত হয়েছে যে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলেছে, সে রাতে কমপক্ষে ৫০০ বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের পুলিশ স্টেশনে রাখা হয়েছে। পিটিআইয়ের দাবি, কিছু মানুষ নিখোঁজ আছেন।
পিটিআই সমর্থকদের একজন বলেন, ‘তিনি (বুশরা) আমাদের ছেড়ে গেছেন।’ কেউ কেউ তাঁর পক্ষে কথা বলছেন। তাঁদের একজন জোরালো গলায় বলেন, এটা তাঁর দোষ নয়। দলীয় নেতাদের চাপে তাঁকে যেতে ঘটনাস্থল ছাড়তে হয়েছে।
বুশরা কি সেটাই চাচ্ছিলেন? এ ঘটনায় স্ত্রী বুশরা বিবির নিজস্ব রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থাকার কথা আগেই নাকচ করে দিয়েছেন ইমরান খান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ইমরানের পক্ষ থেকে দেওয়া পোস্টে লেখা হয়েছে—‘সে (বুশরা) শুধু আমার বার্তাগুলো পৌঁছে দেয়।’
বিবিসি উর্দুকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশ্লেষক ইমতিয়াজ গুল মনে করেন, বিক্ষোভে বুশরার অংশ নেওয়াটা ‘অসাধারণ পরিস্থিতিতে একটি অসাধারণ পদক্ষেপ।’ গুলের ধারণা, ইমরানের অনুপস্থিতিতে দল এবং দলের কর্মীদের সক্রিয় রাখতেই বুশরা বিবি এখন এমন ভূমিকা পালন করছেন।
পিটিআই সদস্যদের কেউ কেউ একই ধারণা পোষণ করেন। তাঁদের ধারণা, ইমরান গভীরভাবে বিশ্বাস করেন বলেই বুশরা এমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তবে পিটিআইয়ের ভেতরে এমন গুঞ্জনও আছে যে বুশরা নেপথ্যে থেকে ভূমিকা পালন করেন। ইমরান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি (বুশরা) তাঁর স্বামীকে রাজনৈতিক নিয়োগ ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতেন।
বুশরার সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকার নজিরটি প্রথম দৃশ্যমান হয় নভেম্বরের শুরুর দিকে যখন তিনি পিটিআই নেতাদের বৈঠক ডাকেন। ইমরান খানের ডাকা সমাবেশকে সমর্থন দিতে তিনি এই বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলছেন, বুশরা সুযোগ নিচ্ছেন। তিনি নিজেকে আসলে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে দেখেন।
লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক আসমা ফাইজের ধারণা, পিটিআই নেতারা হয়তো বুশরা বিবিকে অতটা গুরুত্ব দেননি। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, ধরে নেওয়া হয়েছিল যে তিনি (বুশরা) অরাজনৈতিক মানুষ, তাই তিনি হুমকি হবেন না। তবে গত কয়েক দিনের ঘটনায় ভিন্ন এক বুশরা বিবিকে দেখা গেছে।
তবে বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদেরা কে কী ভাবছেন, সেটা বড় বিষয় নয়। পিটিআই সমর্থকদের অনেকে এখনো বুশরা বিবিকে ইমরানের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের মাধ্যম বলে বিবেচনা করেন। এটা পরিষ্কার যে তাঁর উপস্থিতি পিটিআইয়ের ভিত্তিকে চাঙা রাখার জন্য যথেষ্ট।
ইসলামাবাদের বাসিন্দা আসিম আলী বলেন, ‘তিনিই সেই জন, যিনি সত্যিকার অর্থে তাঁকে মুক্ত করতে চান। আমি তাঁর ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখি।’
বিবিসি