আমি সময়োপযোগী নই, শিল্পোপযোগী: নওশাবা

0
126
কাজী নওশাবা আহমেদ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ভক্ত-অনুসারী কম। নিজেই বলেন, ‘আমার পিআর (পাবলিক রিলেশন) জিরো।’ ফেসবুকে বেশি অনুসারী না থাকায় বাদ পড়েছেন অনেক কাজ থেকেই। তবে মজার ব্যাপার, কাজী নওশাবা আহমেদ পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় সুযোগ পেয়েছেন ফেসবুক সূত্রেই। মুঠোফোনে কথা হয় অভিনেত্রীর। সম্প্রতি শুটিং সেরে দেশে ফিরেছেন। আলাপচারিতায় উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের সিনেমার কাজ, এক যুগের বেশি সময়ের ক্যারিয়ার আর নানা বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ।

কাজী নওশাবা আহমেদ
কাজী নওশাবা আহমেদ, ফেসবুক থেকে

সামাজিক যোগাযোগ
অনীক দত্তর সিনেমা ‘অপরাজিত’ কলকাতায় দেখেছিলেন নওশাবা। দেখার পর নিজের ভালো লাগার কথা জানিয়ে পরিচালকের ফেসবুক মেসেঞ্জারে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। পরিচালক তাঁর ফেসবুক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করবেন কি না, এই বার্তা কবে চোখে পড়বে, জানতেন না তিনি। বাবাকে নিয়ে নিয়মিত ফেসবুকে লেখালেখি করেন নওশাবা। চলতি বছরের শুরুর দিকে হঠাৎ লক্ষ করেন, তাঁর পোস্টে অনীক দত্ত নামে একজনের প্রতিক্রিয়া।

নওশাবা বুঝতে পারছিলেন না, এই অনীক দত্ত ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর নির্মাতা কি না। চলতি বছরের রোজার মাসে হঠাৎ মেসেঞ্জারে পরিচালকের বার্তা, ‘আমি যে নতুন সিনেমা করছি, সেখানে একটি চরিত্র আছে, যেটি তোমার জীবনবোধের সঙ্গে যায়। অডিশন দেবে নাকি?’ এই বার্তা পেয়ে বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না নওশাবার। কোনো যোগাযোগ, পরিচয়, কথাবার্তা ছাড়া এভাবে অডিশনের প্রস্তাব পাবেন, ভাবতেই পারেননি। এরপর কয়েকবার বার্তাবিনিময়, অডিশন শেষে য‘ত কাণ্ড কলকাতাতেই’ সিনেমায় যুক্ত হন নওশাবা।

সত্যজিৎ থেকে সত্যজিতের দার্জিলিং
‘অশনি সংকেত’ খুব প্রিয় ছবি। ববিতা তো অসম্ভব প্রিয় অভিনেত্রী। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাটিতে প্রিয় অভিনেত্রীকে দেখার পর থেকেই স্বপ্নের জাল বোনা শুরু। ভাবতেন, তাঁকেও যদি পর্দায় এভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। মনে পড়ত বাবার কথাও। বাবা বলতেন, ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ছোটবেলা থেকে তাই ভালোমতোই অপেক্ষা করতে শিখেছিলেন নওশাবা। শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো বাবার কথাই, অন্য দেশের সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে সুযোগ পেলেন তিনি। তা–ও কিনা এমন সিনেমায়, যেটা আবার তৈরি হচ্ছে সত্যজিতের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে। আর কাকতালীয়ভাবে সিনেমার প্রথম কিস্তির শুটিং লোকেশন দার্জিলিং। শৈল শহরটির পটভূমিতে দুটো ফেলুদা উপন্যাস আর একটা সিনেমা বানিয়েছেন সত্যজিৎ। দার্জিলিং তাঁর কতটা প্রিয়, বলার অপেক্ষা রাখে না।

কাজী নওশাবা আহমেদ

কেমন ছিল নওশাবার দার্জিলিং-অভিজ্ঞতা? ‘ওরা সেটে নিজেদের দায়িত্ব খুব সঠিকভাবে পালন করে। এ ছাড়া সময় মেনে চলার ব্যাপারেও যত্নশীল—ছয়টার কাজ শুরু হতে হয়তো ছয়টা পাঁচ হতে পারে, এর বেশি নয়। দর্শককে খুব গুরুত্ব দেয়, সবকিছু খুব সিরিয়াসভাবে হয়—ছোট একটা প্রপস না এলে সেটার জন্য শুটিং বন্ধ করে বসে থাকবে। অন্য কোনোভাবে চালিয়ে দেবে না। সব মিলিয়ে কাজের প্রতি এই যে দায়বদ্ধতা, সেটা খুব ভালো লেগেছে। আমি যে নতুন একটা মেয়ে, এটা কেউই বুঝতে দেয়নি। আবীরদা (আবীর চট্টোপাধ্যায়) ছাড়াও ছবির অন্য শিল্পীরাও পরিচিত। কিন্তু কারও মধ্যে তারকাসুলভ ব্যাপার ছিল না, শুটিংয়ে সবাই সমান।’

সিনেমায় নওশাবা অভিনীত চরিত্রটির নাম সাবা, সে বাংলাদেশ থেকে শিকড়ের সন্ধানে দার্জিলিং, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। এই যাত্রায় তার সঙ্গে দেখা হয় আবীর চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রটির। গল্পটি মোড় নেয় অন্যদিকে। নওশাবার ভাষ্যে, এটা খুব সিরিয়াস টাইপ ছবি না, হালকা মেজাজের একটা জার্নির গল্প। অভিনেত্রী আরও জানালেন, সিনেমাটির দ্বিতীয় কিস্তিতে কলকাতায় আরও এক মাস শুটিংয়ে অংশ নেবেন তিনি।

‘নওশাবার তো ফলোয়ার নেই’
‘আমি নিজে অন্তর্মুখী মানুষ। কাজটা ভীষণ ভালোবাসি, এখন পর্যন্ত যা করেছি, সততার সঙ্গে করেছি। কিন্তু আমি আগ বাড়িয়ে বলতে পারি না, ওমুক করছি, তমুক করছি। অনেক লাইভে আসি না। সহজ কথায়, এই মুহূর্তে যেগুলো খুব জরুরি, সেগুলো আমার নেই। এটা যে আমার খুব সবল দিক, তা বলব না কিন্তু আমি এটা পেরি উঠি না,’ বলছিলেন নওশাবা। প্রশ্নটা ছিল তাঁর জনসংযোগ নিয়ে। তাঁর কাছে আরও জানতে চাওয়া, গত এক দশকে তিনি অনেক কাজই করেছেন, কিন্তু নাটক, সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের প্রধান চরিত্রে কেন তাঁকে সেভাবে পাওয়া গেল না?

কাজী নওশাবা আহমেদ
কাজী নওশাবা আহমেদ, ফেসবুক থেকে

অভিনেত্রী বলে গেলেন তাঁর উপলব্ধির কথা, ‘ভিউ বাড়ানোর জন্য যে অনেক কিছু করতে হয়, সেটা করতে পারি না। এ জন্য অনেক অভিনয়ের সুযোগও হাতছাড়া হয়েছে। বলা হয়, “নওশাবার তো ফলোয়ার নেই।” হয়তোবা সবার সঙ্গে আমার তাল মেলানো উচিত ছিল। কিন্তু ওটা করতে গেলে আমার সক্রিয়তা হারিয়ে ফেলতাম। এটা নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই, আমি আমার মতো থেকেই আনন্দ পাই।’ তবে জানিয়ে রাখলেন কষ্টের কথাও, ‘ফলোয়ার নেই বলে ওকে এ কাজটা দেওয়া যাবে না—এটা শুনতে কষ্ট লাগে। বা অনুসারী না থাকায় দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র পাই অথচ যোগ্যতা রাখি প্রধান চরিত্র করার। ফলোয়ার নেই—এই শব্দটা আমি অনেকবার শুনেছি। এটা লুকানোর কিছু নেই। তখন মনে হয়েছে, ফলোয়ার বিষয়টা কী? এরা আসলে কারা? আমি হয়তোবা সময়োপযোগী নই, শিল্পোপযোগী—এতটুকু জানি।’

মানুষের মাঝে খুঁজে বেড়াই
একেক অভিনেত্রী একেকভাবে নিজেকে শাণিয়ে নেন। নওশাবা কীভাবে সেটা করেন? উত্তর দিতে গিয়ে আবারও বাবার কথা স্মরণ করলেন অভিনেত্রী, ‘ছোটবেলায় বাবা বলতেন, পুরো পৃথিবীকে বন্ধু বানিয়ে ফেল। রাস্তায় অপরিচিত কারও সঙ্গে গল্প জমাতে বলতেন। আরও বলতেন, এটা করলে কখনো একা লাগবে না। এই কারণে আমার কখনো একা লাগে না, নিজেকে নিয়ে খুব আনন্দে থাকি। আমি এখনো হুটহাট এখানে–সেখানে চলে যাই, টংদোকানে চা খাই। অভিনেত্রী হওয়ার জন্য যে এসব করি তা না, এটাই আমার জীবন। এটা না করলে আমি আকাশে উড়তে থাকব, সেটা হলে মাটির চরিত্রগুলো কখনো করতে পারব না।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.