আমার বিজয় আটকে আছে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরে

0
136
পান্না কায়সার। ২০১৯ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দেশ শত্রুমুক্ত হলে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর সারা দেশে আনন্দের ধারা বয়ে যায়। বন্দুক হাতে, স্টেনগান নিয়ে দলে দলে ফিরছিল মুক্তিযোদ্ধারা। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখরিত চারদিক। ঘরের মানুষ বেরিয়ে আসে পথে। মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানানোর জন্য রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে আসে দেশ।

সেদিনের বিজয়ের আনন্দ উল্লাসে আমারও অংশীদার হওয়ার কথা ছিল। কী নিষ্ঠুর নিয়তি, আমি পারলাম না। ১৬ ডিসেম্বরে রিকশা করে ছোড়দাসহ (আমার দেবর) ঢাকার রাস্তায় বেরিয়েছিলাম ঠিকই। তবে বিজয়ের আনন্দ উত্সবে শরিক হওয়ার জন্য নয়, একজন জীবন্ত মানুষকে খুঁজতে। দেখলাম ছেলে, যুবা, মা-বোনেরা রাস্তার ধারে আনন্দে মেতেছে। মা-বোনের কপালে টিপ, খোঁপায় ফুল। হাতে ফুল। মনে মনে ভেবেছি, ওকে খুঁজে পাই আগে আমিও এভাবে ওর হাত ধরে রাস্তায় নামব। কিন্তু আমি কী জানতাম আমি কোথায় যাচ্ছি? কী বীভত্স দৃশ্য আমাকে একটু পরেই দেখতে হবে।

ছোড়দা আমাকে জহুর হোসেন চৌধুরীর বাসায় নিয়ে গেল। মামাকে (জহুর হোসেন চৌধুরীকে মামা ডাকতাম) জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। মামা শহীদুল্লার খবর ১৪ তারিখেই শুনেছেন। প্রথম ফোনটা তাঁকেই কাঁদতে কাঁদতে করেছিলাম। আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, অপেক্ষা করো। দেশ তো শত্রুমুক্ত হয়েই যাচ্ছে। এমনও তো হতে পারে, ওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরে মামার মুখখানায় গম্ভীর ছাপ লক্ষ করেছি। মামা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, একজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে বিয়ে করেছ; যোগ্য স্ত্রী হিসেবেই শক্ত হয়ে বাস্তবের মোকাবিলা করতে হবে। ছোড়দাকে কানে কানে কী যেন বললেন। ছোড়দা আমার হাতখানা ধরে বলল, চলুন। আমার প্রশ্ন, ‘কোথায়?’ বলল, ‘বড়দাকে খুঁজতে।’ মনে মনে হালকাবোধ করলাম। ভাবলাম, মামা নিশ্চয়ই জানেন শহীদুল্লাকে কোথায় আটকে রেখেছে। ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহীদুল্লা কায়সারকে আলবদর-রাজাকাররা ২৯ বি কে গাঙ্গুলী লেন থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিনের চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার জীবনটা এভাবে পাল্টে যাবে সেদিন ভাবিনি।

সেদিন সন্ধ্যায় দোতলায় সিঁড়ির পাশেই বসার ঘরে শহীদুল্লা কায়সার আমার ছয় মাসের ছেলেসন্তানকে সোফায় ঘুম পাড়িয়ে কাগজে সংবাদের জন্য বিভিন্নভাবে হেডলাইন লিখেও তৃপ্তি পাচ্ছিল না। আমি মেয়েকে নিয়ে নিচে কার্পেটের ওপর বসে বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। তখন ঢাকা শহরে কারফিউ ব্ল্যাকআউট। ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। হঠাত্ ছোট দেবর ছুটে এসে বলল, ‘বড়দা, কিছু লোক বাইরে গেট ধাক্কাচ্ছে। খুলব?’ কথাটা শুনতেই কায়সার বলল, ‘তাড়াতাড়ি খোল। নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ।’ দেবর ঝটপট নেমে গেল। শহীদুল্লা কায়সার আমার আঁচল থেকে চাবি নিয়ে ঝটপট কিছু টাকা হাতে রাখল। আমি বললাম, ‘টাকা কেন?’ বলল, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের লাগতে পারে।’ কিন্তু নিচ থেকে কোনোই সাড়া-শব্দ নেই। শহীদুল্লা বলল, ‘পাড়ার কেউ হয়তো আশ্রয়ের জন্য এসেছে।’ কথা শেষ না হতেই মুখে কালো কাপড় বাঁধা পাঁচ-ছয়জন ছেলে ঘরে ঢুকেই বলল, ‘এখানে শহীদুল্লা কায়সার কে?’ লোকগুলো দেখে আমি মেয়েকে কোল থেকে ফেলে উঠে দাঁড়াতেই শহীদুল্লা কায়সার বলল, ‘কেন? আমিই শহীদুল্লা কায়সার।’ অমনি লোকগুলো ওকে টেনে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি দৌড়ে শহীদুল্লার হাত টেনে ধরে বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে চিত্কার করে সবাইকে ডাকতে শুরু করলাম। কিন্তু নিচে ওদের আরও কিছু লোক স্টেনগানের নলে সবাইকে আটকে ফেলেছে। আমার চিত্কারে আমার পাশের রুমে থাকা আমার ননদ ছুটে এল। আমি ইতিমধ্যে একজনের মুখের কাপড় টেনে খুলে ফেললাম। আমার অন্তঃসত্ত্বা ননদও তার ভাইয়ের হাত ধরে টানছিল। কিন্তু ওরা ওকে এত জোরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল যে একসময় আমার হাতখানা ওর হাত থেকে ছুটে গেল। শহীদুল্লা কায়সার ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি মেলে আমাকে বলল, ‘ভালো থেকো।’ মুহূর্তে কী যে হয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই ওরা ওকে নিয়ে চলে গেল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে দেখি বাড়ির সবাই আমাকে ঘিরে। আমি আবার জ্ঞান হারাই। আবার জ্ঞান ফেরে। আমার দেবর বোধহয় আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই বলল, ‘ভাবি শান্ত হন। বড়দাকে বোধহয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই ধরে নিয়ে গেছে। দেশ তো শত্রুমুক্ত হয়েই যাচ্ছে। বড়দাকে খুঁজে পাব।’ ইতিমধ্যে ফোনের লাইন কাটা। কীভাবে ১৪ তারিখ ১৫ তারিখ কেটেছে আজও আমার স্মরণে নেই। ১৫ তারিখ রাতে খবর আসতে থাকল দেশ শত্রুমুক্ত। সারা রাত কেটেছে প্রতিক্ষায়, কখন সকাল হবে। কখন ওকে খুঁজতে যাব। ১৬ তারিখ সকালেই ছোড়দা আমাকে নিয়ে বের হলো। রিকশায় বসে বিজয়ের উল্লাস দেখেও অনুভবে কোনো বোধই জাগেনি। জহুর মামার বাসা থেকে আমার দেবর নিয়ে গেল রায়েরবাজারের বধ্যভূমির কাছে। অসংখ্য মানুষ কাঁদছে মুখে কাপড় দিয়ে। বধ্যভূমিতে পড়ে থাকা অসংখ্য লাশের মধ্যে খুঁজে খুঁজে দেখছে আপনজনদের। আমি যা বোঝার তা-ই বুঝে ফেললাম। একজন জীবন্ত মানুষকে খুঁজতে এসে কাদা-পানি মাড়িয়ে আমিও লাশের কাফেলায় একটা একটা করে লাশ খুঁজে বেড়িয়েছি। মিলল না কোথাও। ফিরে এলাম।

এবারের ডিসেম্বর মাসের তাত্পর্যটা অন্যভাবে অনুভবে জাগে। এবার সরকার ঘোষণা দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হবে ডিসেম্বরে। এ দাবি তো জনগণের দীর্ঘদিনেরই দাবি। এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির জ্বালামুখ খুলেছে। এবারের বিজয়ের মাসে আমার স্বামীর হত্যাকারীর বিচার দীর্ঘ বছর পর হবে, এটুকু ভেবে সান্ত্বনা পাই। তার মধ্যেও এ মাসটিতে বারবার রায়েরবাজারের বধ্যভূমির বীভত্স দৃশ্য আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। একজন জীবন্ত মানুষ খুঁজতে গিয়ে অজস্র মানুষের লাশ উল্টেপাল্টে খুঁজে দেখা কোনো নারীর ভাগ্যে যেন না ঘটে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করে জাতির কপাল থেকে যেমন কলঙ্ক মুছে গেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তেমনি জাতি কলুষমুক্ত হোক-এখন এ প্রত্যাশাই বড় প্রত্যাশা। হয়তো তখন আমিও পাব বিজয়ের আনন্দের কিছুটা স্বাদ, যা থেকে ৩৮ বছর বঞ্চিত হয়ে আছি।

পান্না কায়সার: লেখক, শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.