আমদানি-রপ্তানিতে বিলিয়ন বা শতকোটি ডলারের ক্লাবে শীর্ষে রয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ বা এমজিআই। এক বছর বিরতি দিয়ে আবার এই ক্লাবে ফিরেছে ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বিএসআরএম গ্রুপ। এই ক্লাব থেকে ছিটকে গেছে আর্থিক খাতে লুটপাটের দায়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত এস আলম গ্রুপ। সব মিলিয়ে এবার বিলিয়ন ডলার ক্লাবে জায়গা করে নিয়েছে দেশের আট শিল্প গ্রুপ।
সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের আমদানি ও রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। আর এ তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ক্রমতালিকা অনুযায়ী, বিলিয়ন বা শতকোটি ডলারের ক্লাবে জায়গা পাওয়া আট শিল্প গ্রুপ হলো যথাক্রমে এমজিআই, আবুল খায়ের গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল, বিএসআরএম গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ, টি কে গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপ।
গত অর্থবছরে এই আট শিল্প গ্রুপের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ছিল ১ হাজার ২২৩ কোটি ডলারের। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে শীর্ষ আট শিল্প গ্রুপের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৬৬ কোটি ডলার। সেই হিসাবে শীর্ষ আটটি শিল্প গ্রুপের সম্মিলিত আমদানি-রপ্তানি আগের অর্থবছরের চেয়ে ১০ শতাংশ কমেছে।
বিলিয়ন ডলার ক্লাবে জায়গা করে নেওয়া শিল্প গ্রুপগুলোর আমদানির বড় অংশই শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি। আর রপ্তানির তালিকায় রয়েছে খাদ্যপণ্য, ইলেকট্রনিকস, রাসায়নিক, পোশাক ও বস্ত্র। ডলার-সংকটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য আমদানি ব্যাহত হয়েছে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর। তাতে আমদানি কমেছে অনেকের। তবে ডলার-সংকটে পড়ে রপ্তানিতে জোর দিয়েছে অনেকে। তাতে আমদানি কমলেও বেশির ভাগ শিল্প গ্রুপের রপ্তানি বেড়েছে।
শিল্প গ্রুপগুলোর আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বিলিয়ন ডলার হওয়ার অর্থ হলো এসব গ্রুপের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ আমদানি-রপ্তানির পরিমাণের চেয়ে বেশি। কারণ, কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদনে যে মূল্য সংযোজন হয়, তা গ্রুপগুলোর বার্ষিক লেনদেন বাড়িয়ে দেয়।
বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান দুই খাত আমদানি-রপ্তানির লেনদেন ধরে দ্বিতীয়বারের মতো বিলিয়ন ডলার ক্লাবের এই তালিকা তৈরি করেছে। শিল্প গ্রুপগুলোর শুধু মূল প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানির হিসাব এ তালিকা তৈরিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় গ্রুপের যৌথ বিনিয়োগ ও মূল গ্রুপের বাইরে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের হিসাব এ তালিকায় ধরা হয়নি। এ ছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানকেও তালিকায় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
এবারও শীর্ষে এমজিআই
কয়েক বছর ধরে টানা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ বা এমজিআই। নতুন নতুন শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ ও কাঁচামাল আমদানি করে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে গ্রুপটি। গ্রুপটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭২ লাখ টন কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক-করসহ ব্যয় করেছে ২৬১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার বা ২৮ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা (কাস্টমস নির্ধারিত ডলারের বিনিময়মূল্য বিবেচনায়)। গ্রুপটির আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। গত অর্থবছরে শিল্প গ্রুপটির রপ্তানির পরিমাণ ১৭ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ৮ কোটি ১৭ লাখ ডলার আয় হয়েছে পণ্য রপ্তানি করে। বাকি ৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে সমুদ্রগামী জাহাজে পণ্য পরিবহন খাত থেকে। সব মিলিয়ে গ্রুপটি গত অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানিতে ২৭৯ কোটি ডলার বা ৩০ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা লেনদেন করেছে। আমদানি পর্যায়ে সরকারকে রাজস্ব দিয়েছে ৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা।
প্রায় ৪৭ বছর আগে উদ্যোক্তা মোস্তফা কামালের হাত ধরে এমজিআই শিল্পগোষ্ঠীর যাত্রা শুরু হয়। গ্রুপটির প্রধান ব্র্যান্ড ‘ফ্রেশ’। গ্রুপটিতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার মানুষের। শিল্প গ্রুপটির ২২টি খাতে অর্ধশত কারখানা রয়েছে। গ্রুপটির হাতে রয়েছে চারটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলও।
জানতে চাইলে এমজিআইয়ের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম আগের তুলনায় কম ছিল। আবার আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও চাহিদা কমায় বিগত অর্থবছরে আমদানি কমেছে। তবে দেশীয় বাজারের পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে আমরা বিদেশের বাজারে দেশীয় পণ্য ও সেবা রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ কারণে রপ্তানি বাড়তির দিকে রয়েছে।’ তিনি মনে করেন, দেশের চলমান পরিস্থিতি ও ব্যবসার পরিবেশ স্থিতিশীল হলে নতুন বিনিয়োগ হবে। তাতে কর্মসংস্থানও বাড়বে।
এগিয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ
এক বছরের ব্যবধানে সিটি গ্রুপকে পেছনে ফেলে আমদানি-রপ্তানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে আবুল খায়ের গ্রুপ। গ্রুপটি মূলত সিমেন্ট, রড ও ঢেউটিনের মতো ভারী শিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তামাক, খাদ্যপণ্য ও চা খাতেও ব্যবসা রয়েছে তাদের। গ্রুপটি গত অর্থবছরে ৯০ লাখ টন কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় করেছে ১৮৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার। আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো গ্রুপটি ইস্পাত খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।
আমদানির পাশাপাশি আবুল খায়ের গ্রুপের রপ্তানিও আগের অর্থবছরের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে গত অর্থবছরে ৪ কোটি ৩৫ লাখ ডলারে উন্নীত হয়েছে। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে খাদ্যপণ্য, চা, তামাক, সিমেন্ট, জিংক অক্সাইড, বাল্ক ব্যাগ ইত্যাদি। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে গ্রুপটি আমদানি-রপ্তানিতে লেনদেন করেছে ১৯২ কোটি ডলার বা ২২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। এ সময় আমদানিতে সরকারকে রাজস্ব দিয়েছে ৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
আবুল খায়ের গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়েছিল শিল্পোদ্যোক্তা আবুল খায়েরের হাত ধরে। ১৯৫০ সালে মুদিদোকান দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া এই গ্রুপকে শীর্ষে নিয়ে গেছেন আবুল খায়েরের সন্তানেরা।
তৃতীয় অবস্থানে সিটি গ্রুপ
বিলিয়ন ডলার ক্লাবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিটি গ্রুপ। গত অর্থবছর গ্রুপটি সাড়ে ২১ লাখ টন পণ্য আমদানিতে শুল্ক-করসহ খরচ করেছে ১৬৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ অর্থই খরচ হয়েছে ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল, অপরিশোধিত তেল-চিনি, তৈলবীজ, গম ও ডাল আমদানিতে।
গত অর্থবছরে গ্রুপটির রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৮ লাখ ডলার। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে খাদ্যপণ্য ও ভোজ্যতেল। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে গ্রুপটি আমদানি-রপ্তানিতে লেনদেন করেছে ১৬৭ কোটি ডলার বা ১৮ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে গ্রুপটির লেনদেন ছিল ২২৬ কোটি ডলার।
নিত্যপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাতই সিটি গ্রুপের মূল ব্যবসা। নিত্যপণ্য ছাড়াও প্রাণিখাদ্য, চা-বাগান, জাহাজ নির্মাণ, এলপিজি খাতে বিনিয়োগ রয়েছে গ্রুপটির। গ্রুপটির হাতে রয়েছে তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল।
প্রয়াত শিল্পোদ্যোক্তা ফজলুর রহমানের হাত ধরে ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু হয় সিটি গ্রুপের। গত বছর ফজলুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। এখন দ্বিতীয় প্রজন্ম এই গ্রুপের হাল ধরেছে। গত দুই দশকে গ্রুপটির বহরে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। গ্রুপটির প্রধান ব্র্যান্ড তীর।
রপ্তানিতে শীর্ষে প্রাণ-আরএফএল
বিলিয়ন ডলার ক্লাবে চতুর্থ অবস্থানে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। তবে এই ক্লাবে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রপ্তানিতে শীর্ষস্থানটা বরাবরের মতো শুধুই প্রাণ-আরএফএলের। দেশীয় আর রপ্তানি বাজারে সমান পদচারণ এই শিল্প গ্রুপের।
গত অর্থবছরে গ্রুপটি প্রায় ১০৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে আমদানি প্রতিস্থাপক ও রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল। দেশে পণ্য বাজারজাতের পাশাপাশি রপ্তানিতেও এগিয়ে আছে প্রাণ-আরএফএল। পোশাকের বাইরে দেশের রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য এসেছে প্রাণ-আরএফএলের হাত ধরে। গ্রুপটি গত অর্থবছর পোশাকের বাইরে ৩৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। পোশাক খাতে তাদের রপ্তানি ৭ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে গ্রুপটি আমদানি-রপ্তানিতে লেনদেন করেছে ১৫৯ কোটি ডলার বা ১৭ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে গ্রুপটি ১২৬টি দেশে পণ্য রপ্তানি করেছে। গ্রুপটিতে সরাসরি কর্মরত রয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার লোক।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা রপ্তানি বাজার ও পণ্যের বহুমুখীকরণে চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত আছে। নানা উদ্যোগের কারণে রপ্তানিও বেড়েছে। আর অনেক পণ্য ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল এখন আমরা দেশেই উৎপাদন করছি বলে আমদানি কমেছে।’
আহসান খান চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা আছে। তবু আমরা যদি সবাই মিলে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরি, তাহলে বিশ্বও আমাদের ইতিবাচকভাবে দেখবে।’
আবার শীর্ষ আটে ফিরল বিএসআরএম
শুধু একটি খাতের ব্যবসা দিয়েই বিলিয়ন ডলারের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের শীর্ষ আটে জায়গা করে নিয়েছে লোহা ও ইস্পাত খাতের বিএসআরএম গ্রুপ। দেশের রডের বাজারের বড় অংশই গ্রুপটির হাতে। এর বাইরে সম্প্রতি কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প কাজুবাদাম খাতে বিনিয়োগ করেছে গ্রুপটি।
গত অর্থবছর গ্রুপটি ১১২ কোটি ৪২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আমদানির ৭৬ শতাংশই রড তৈরির মধ্যবর্তী কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরা। এ ছাড়া রয়েছে মূলধনি যন্ত্রাংশ। একই সময়ে গ্রুপটি ১ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ১৯৫২ সালে যাত্রা শুরু করা গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছে এখন তৃতীয় প্রজন্ম।
বিএসআরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমের আলীহুসাইন বলেন, ‘অবকাঠামো খাতে আমাদের আরও ভালো করার সুযোগ আছে। এ জন্য এ খাতের প্রধান উপকরণ ইস্পাত পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছি। তবে এখন অবকাঠামো খাতে যে স্থবিরতা চলছে, তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না। কর্মসংস্থানও বাড়বে না।’
১০০ দেশে রপ্তানির মাইলফলকে স্কয়ার গ্রুপ
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী স্কয়ার গ্রুপের রপ্তানি পণ্যের গন্তব্যও এখন শততম বা ১০০ দেশ ছাড়িয়েছে। গত দুই অর্থবছর মিলিয়ে গ্রুপটি ১০২টি দেশে তাদের পণ্য রপ্তানি করেছে। পৃথিবীর ছয় মহাদেশেই পৌঁছে গেছে এই শিল্প গ্রুপের পণ্য।
গত অর্থবছর গ্রুপটি ৭০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আমদানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে ওষুধ, প্রসাধন, পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল, মসলা এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি। আর গত অর্থবছরে গ্রুপটি রপ্তানি করেছে প্রায় ৩৭ কোটি ডলারের পণ্য। রপ্তানির বড় অংশই তৈরি পোশাক খাতের। পোশাক খাতে নেতৃত্ব দেওয়া শীর্ষ ১০ শিল্প গ্রুপের একটি স্কয়ার গ্রুপ। তৈরি পোশাক ছাড়াও ওষুধ, প্রসাধন, খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে গ্রুপটি। দেশেও বাজারজাত হচ্ছে স্কয়ারের পণ্য। সব মিলিয়ে গ্রুপটি গত অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানিতে ১০৭ কোটি ডলার বা ১১ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা লেনদেন করেছে। স্কয়ার গ্রুপ এবার বিলিয়ন ডলার ক্লাবের তালিকায় দুই ধাপ এগিয়ে ষষ্ঠ অবস্থানে উন্নীত হয়েছে।
চার বন্ধুর হাত ধরে ১৯৫৮ সালে যাত্রা শুরু করলেও স্কয়ারের মূল কান্ডারি ছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। তাঁর প্রয়াণের পর সন্তানেরাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের অন্যতম পুরোনো এই শিল্প গ্রুপকে।
জানতে চাইলে স্কয়ার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান ও স্কয়ার ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, ‘যেভাবে দেশে বছর বছর ব্যবসার খরচ বাড়ছে, তাতে আমরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। এ কারণে আমাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। পণ্যের উৎপাদন খরচ যাতে না বাড়ে এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় যাতে আমরা এগিয়ে থাকতে পারি, সরকারের পক্ষ থেকে এমন নীতিসহায়তা পেলে আমাদের রপ্তানি ও পণ্যের বিশ্ববাজার আরও বড় হবে। সেই সঙ্গে দেশে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগও বাড়বে। বর্তমানে ব্যবসার খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।’
টি কে গ্রুপ
গত অর্থবছর গ্রুপটি ১০২ কোটি ২৬ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। গ্রুপটির আমদানির তালিকায় রয়েছে ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল, ইস্পাত পাত, ঢেউটিনসহ শিল্পের কাঁচামাল। গ্রুপটি গত অর্থবছরে রপ্তানি করেছে ৮৩ লাখ ডলারের পণ্য। রপ্তানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে খাদ্যপণ্য, প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও কারখানার নানা উপজাত। সব মিলিয়ে গ্রুপটি গত অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানি খাতে লেনদেন করেছে ১০৩ কোটি ডলার বা ১২ হাজর ২১৯ কোটি টাকা।
প্রায় অর্ধশত বছর আগে টি কে গ্রুপের সূচনা হয়েছিল মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও মোহাম্মদ আবুল কালাম—দুই ভাইয়ের হাত ধরে। বাংলাদেশে শিল্পায়নের শুরুর দিকে অনেক খাতে প্রথম কারখানার সূচনা হয়েছিল তাঁদের হাতে। এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে গ্রুপের নেতৃত্ব।
বসুন্ধরা গ্রুপ
বিলিয়ন ডলার ক্লাবে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। গত অর্থবছরে গ্রুপটি ১০১ কোটি ডলারের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে। গ্রুপটির আমদানির তালিকায় রয়েছে সিমেন্ট, ভোগ্যপণ্য, কাগজ ও বিটুমিন শিল্পের কাঁচামাল। গ্রুপটি কয়লা ও পাথরের বাণিজ্যেও যুক্ত হয়েছে। গ্রুপটি রপ্তানি করেছে ১ কোটি ১৬ লাখ ডলারের পণ্য। এই তালিকায় রয়েছে খাদ্যপণ্য, টিস্যু, কাগজ ইত্যাদি। সব মিলিয়ে গ্রুপটি গত অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানি খাতে ১০২ কোটি ডলার বা ১১ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা লেনদেন করেছে।
ছিটকে গেছে এস আলম
২০২২-২৩ অর্থবছরে এস আলম গ্রুপ ১৪০ কোটি ডলারের ভোগ্যপণ্য আমদানি করে মূলত বিলিয়ন ডলারের ক্লাবে নাম লিখিয়েছিল। ট্রেডিং-নির্ভর হয়ে ওঠা গ্রুপটি সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যার সিংহভাগ ভোগ্যপণ্য। আমদানি কমে যাওয়ায় বিলিয়ন ডলার ক্লাব থেকে ছিটকে পড়েছে গ্রুপটি।
শক্তি দেশীয় বাজার, নজর রপ্তানিতে
দেশে নিত্যপণ্য থেকে নিত্যব্যবহার্য পণ্য কিংবা সাধারণ পণ্য থেকে শিল্পপণ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এই চাহিদাকে পুঁজি করে বিলিয়ন ডলারের গ্রুপগুলো আমদানি প্রতিস্থাপক কারখানা গড়ে তুলেছে। তাদের শক্তির জায়গা দেশীয় বাজার।
তবে দুই বছরের বেশি সময় ধরে ডলার-সংকট শিল্প গ্রুপগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই প্রাণ-আরএফএল ও স্কয়ার গ্রুপের মতো অন্য গ্রুপগুলোও এখন রপ্তানিতে নজর দিয়েছে। যদিও আমদানির তুলনায় তাদের রপ্তানি এখনো নগণ্য। তবু এসব গ্রুপের রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ক্রমবর্ধমান স্থানীয় বাজারের ওপর ভিত্তি করে আমদানি প্রতিস্থাপক কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পণ্যের মান উন্নয়ন করে রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করছেন তাঁরা। এতে প্রস্তুত পণ্যের আমদানি কমছে, রপ্তানি বাড়ছে—যা শিল্পায়নের ভালো দিক। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প যাতে বিকাশের সুযোগ পায়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, এখনকার বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিগুলো একসময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি থেকেই বিকশিত হয়েছে। এখনকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে পদক্ষেপ নেওয়া হলে তারাও একদিন বড় হবে।
মাসুদ মিলাদ,চট্টগ্রাম