অনলাইনে গরু বেচাকেনা করা যাচ্ছে। ২০২৩-এ এসে এ ধরনের খবর বেশ চোখে পড়ছে। নইলে আজ থেকে ৫০ বছর আগের ঈদ, আর আজকের ঈদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য চোখে পড়ে কি! বাংলাদেশের ঈদুল আজহার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আমার চোখে অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। সত্য বটে, ঈদ ছোটবেলায় যত তীব্র আনন্দের উপলব্ধি নিয়ে আসত, বড়বেলায় তার তীব্রতা কমে গেছে, এর বদলে এখন বড় হয়ে উঠেছে দায়িত্ব। কোরবানির ঈদ বা বকরি ঈদের আগে আপনি কি ছোটবেলায় এই কাজগুলো করেছেন—
১. আপনি কি ঈদের আগে ছুরি, দা ইত্যাদি নিজে ধার করেছেন। দা-ছুরি, বঁটি ধারালো করার জন্য আপনি কি নিজ হাতে বাঁশ, কাঠ কিংবা পাথরের ওপরে ঘষেছেন? অন্তত ‘ছুরি-কাঁচি ধার করা হয়’, এই ফেরিওয়ালাকে ডেকে এনে তাঁর ঘূর্ণমান চাকায় ছুরি-কাঁচি ধার করাতে দিয়েছেন?
২. ছাগলের জন্য কাঁঠালের পাতা জোগাড় করেছেন? গরুর জন্য খড়? গরু-ছাগলের মুখে কাঁঠালপাতা ধরেছেন?
৩. বড়দের পেছনে পেছনে গরুর হাটে গেছেন?
৪. ঈদের আগে নিজের হাতে ঈদকার্ড তৈরি করেছেন?
৫. আপনারা গরু, না খাসি বলে রসিকতা করেছেন?
৬. নিজের হাতে গরুর মাংস কেটেছেন? গরুর চামড়া ছাড়ানোর সময় পা ধরে রাখার কাজ পেয়েছেন?
৭. প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাংস দিয়ে এসেছেন?
৮. ঈদের দিন কোমল পানীয় কেনা বা খাওয়াকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন?
৯. ঈদের আগের রাতে হাতে মেহেদি দিয়েছেন?
১০. ব্যাগভরে ঈদের কেনাকাটা করার জন্য চটের ব্যাগ নিয়ে ঈদের আগের দিনগুলোয় বাজার গেছেন?
এর সঙ্গে অনূর্ধ্ব–৩০-এর ছেলেবেলার জন্য:
১১. আপনি কি কোরবানির পশুর সঙ্গে সেলফি তুলেছেন?
১২. আপনি কি কোরবানির হাটে গিয়ে টিকটক করেছেন?আমাদের-তোমাদের-তাহাদের ঈদ
প্রথম ১০টা বিষয়ের সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই অনেকগুলোই মিলে যায়। তাই বলছিলাম, আমাদের সবার ঈদের স্মৃতি একই রকমের। এবং তা খুব বদলে যায়নি। কিন্তু আমাদের দুনিয়াটা কত তাড়াতাড়ি বদলে গেল। ৩০ বছর আগে, আমার ঢাকার বাসায় একটা ল্যান্ডফোনও ছিল না। সে সময় যাঁদের বাড়িতে ফোন ছিল, তাঁদের অনেকেই ফোন তালা দিয়ে রাখতেন। বিদেশ থেকে কল আসবে, প্রতিবেশীর বাড়িতে নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। হঠাৎ জরুরি কল করার জন্য পড়শির বাড়িতে যাওয়া ছিল একটা মহা বিব্রতকর অভিজ্ঞতা।
এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে স্মার্টফোন। চট্টগ্রামের গ্রাম থেকে গৃহিণী বয়স্ক মা ফোন করেন ঢাকায় কর্মরত কিংবা অধ্যয়নরত সন্তানকে, ভিডিও কল; রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সন্তানের মুখটা একটুখানি মা দেখতেই চান। সাগরের ওপার থেকে ভিডিও কল হরহামেশাই আসছে বাংলাদেশের জনপদে জনপদে।
ঈদের স্মৃতি, ভবিষ্যৎ ভাবনা
আজকের ছেলেমেয়েদের বোঝানো যাবে না, ৩০ বছর আগেও আমাদের জীবনটা ছিল ফোনবিহীন। তখন অনেকের বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। আর টেলিভিশনে চ্যানেল ছিল মাত্র একটা। টেলিভিশন কেন্দ্র রোজ বিকেলে খুলত, রাত ১২টার দিকে সেটা জাতীয় সংগীত বাজিয়ে বন্ধ হয়ে যেত।
ইন্টারনেট, ই–মেইল, ফেসবুক বলতে কোনো পদার্থ শুধু বাংলাদেশে নয়, ৪০ বছর আগে পৃথিবীর কোথাও ব্যবহৃত হতো না। ১৯৮৯ সালে আমেরিকায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হয়। আর এখন, প্রত্যেক স্মার্টফোনধারী পকেটে একটা করে টিভি-স্টেশন নিয়ে ঘুরছেন, যখন ইচ্ছা তখন তিনি লাইভে গিয়ে খবর কি গান কি ভ্রমণের অনুষ্ঠান সরাসরি প্রচার করতে পারেন।
সবকিছু বদলে যাচ্ছে বটে। বাংলাদেশের রাস্তাঘাট যোগাযোগও হচ্ছে উন্নততর। আমার মনে আছে, রংপুর–ঢাকা প্রথম যেবার এসি বাস চালু করা হলো, রংপুরের যাত্রীরা প্রতিবাদ করেছিলেন, ‘ঠান্ডার এলাকাত থাকি, এসি দিয়া হামরা কী করমো।’ নব্বইয়ের দশকে সাংবাদিক শ্যামল দত্ত চট্টগ্রাম থেকে এলেন এসি বাসে, তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এসি বাসে চড়তে কেমন লাগে! তিনি জবাব দিয়েছিলেন, দেখেন না, মাথার চুল এলোমেলো হয়নি, কেউ বুঝবে আমি জার্নি করে এলাম! সৈয়দপুরে প্লেন নামত, সপ্তাহে তিন দিন, টিকিট বিক্রি হতো না। এখন রোজ আটটা ফ্লাইট সৈয়দপুর যায়, প্রতিটি ফ্লাইট ফুল।
আমাদের ঈদ-জীবন আর সম্পর্কের উদ্যাপন
এবার কমলাপুরে টিকিটের জন্য লাইন নেই। টিকিট অনলাইনে বিক্রি হয়ে গেছে। ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়ছে, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত। আর আমাদের সময়ে? সারা রাত কমলাপুরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। সকালবেলা কাউন্টারে যাওয়ার আগে আগে জানা গেল টিকিট শেষ।
একবার আমি আর আমার মেজ ভাই দুপুরবেলা কমলাপুর স্টেশনে গেলাম। বেলা একটায় উঠলাম একতা এক্সপ্রেসে। বসার জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। এত মানুষ কামরায়। রাতে গিয়ে ট্রেন দাঁড়াল বাহাদুরাবাদ ঘাটে। এরপর স্টিমার।
সারা রাত স্টিমার এল না। আমরা নদীর চরে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে সারা রাত বসে থাকলাম। পরের দিন সকাল ১০টার দিকে স্টিমার এল। স্টিমারে চড়ে যেতে হবে ফুলছড়ি। তারপর বোনারপাড়া হয়ে সেই ট্রেন সন্ধ্যার দিকে আমাদের রংপুর স্টেশনে নামাল। ২৮ ঘণ্টার বেশি লাগল ঢাকা–রংপুর। এখন যানজট না থাকলে ঈদের আগেও এই পথ আট ঘণ্টার মধ্যে পাড়ি দেওয়া সম্ভব। এখন পদ্মা সেতু দিয়ে লোকে খুলনা যাচ্ছে তিন-চার ঘণ্টায়।
কত কী বদলাচ্ছে! বদলাচ্ছে না আমাদের ভেতরের মায়া-মমতা। আমরা এখনো ঈদে বাড়ি ছুটে যাই। সন্তান জড়িয়ে ধরে বাবা-মাকে। ভাইবোনেরা একত্র হয়। কত দিন পর ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়। ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
অন্যদিকে কত দূর এগোল মানুষ! কিন্তু এখনো থামল না যুদ্ধ! এখনো ফিলিস্তিনি শিশুরা মারা যাচ্ছে! সিরিয়ায় সুদানে বোমারু বিমান ছুটে চলেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ করেই চলেছে! এটা ২০২৩ সাল? কবে মানুষ মানুষ হবে!
আরেকটা বিষয়। আমরা অনলাইনে গরু–ছাগল কিনছি। কিন্তু এখনো আমরা ঢাকা শহরে রাস্তার ওপরে কোরবানি দিই। এই রকমটা পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও ঘটে না। সৌদি আরবে নয়, আরব আমিরাতে নয়, মালয়েশিয়াতে নয়, ইউরোপ-আমেরিকাতে তো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যখন আরও উন্নত হব, মধ্যম আয় থেকে উচ্চ আয়ের দেশ হব, তখন নিশ্চয়ই আমাদের দেশেও কোরবানির জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসম্মত জায়গা হবে, যেখানে আমরা সুন্দরভাবে যার যার মতো পশু কোরবানির ব্যবস্থা করতে পারব। এই ফাঁকে সিটি করপোরেশনগুলোকেও ধন্যবাদ দিতে হয়, তারা কোরবানির বর্জ্য পরিষ্কার করার পাহাড়সম কাজটা প্রতিবার সুসম্পন্ন করার বিশেষ ব্যবস্থা নেয় বলে।
ঈদ উদযাপনে জৌলুস বেড়েছে, সেই আবেগ কি আর আছে?
আর কবে আমরা শুনতে পাব, বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন কীভাবে হবে, এই নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছে!
থাক! ঈদের আগে বরং পড়ি কাজী নজরুলের কবিতা:
সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের!
কারও আঁখি-জলে কারও ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?
● আনিসুল হক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক