আনোয়ার ইব্রাহিম সরকারের সামনে নানা চ্যালেঞ্জ

0
192
আনোয়ার ইব্রাহিম

মালয়েশিয়ার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০০৭ সালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই. স্টিগলিজ মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উত্থান ও একটি প্রাণবন্ত বহুজাতিক সমাজ সৃষ্টির বিষয়কে ‘মিরাকল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর পর গত ১৫ বছরে মালয়েশিয়ায় সে ধারা চালু থাকলেও বড়মাপের দুর্নীতির খবর এবং বিদেশি শ্রমিকদের নিপীড়নের ঘটনায় দেশটির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। তা অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতায়ও ইন্ধন জোগায় এবং মালয়েশিয়ার ভাগ্য হাঁটে বিপরীত দিকে। এ পরিস্থিতিতে গত বছরের শেষদিকে দীর্ঘ দিনের বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর কার্যকর ও দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্বের রেকর্ড আশা জাগাচ্ছে; মালয়েশিয়া একটি স্থিতিশীল উন্নয়নের পথে ফিরে আসছে, যা আরও বেশি মানুষকে বৃহত্তর সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। উপপ্রধানমন্ত্রী ও নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিমের দায়িত্ব পালনকালে দেশটি দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি দেখে এবং তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম ‘টাইগার কাব’ অর্থনীতি হিসেবে মালয়েশিয়ার উত্থানকে সম্ভব করেছে। যখন এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট ব্যাপকভাবে দেখা দেয়, তিনি মালয়েশিয়ায় এর প্রভাব প্রশমনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং সবকিছু সহজেই নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হন।

আনোয়ার ইব্রাহিমের রেকর্ড মালয়েশিয়ার আরেক অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নাজিব রাজাকের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। নাজিবের সময়ে মালয়েশিয়া কয়েক বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি কেলেঙ্কারির মধ্যে পড়ে এবং রাষ্ট্রীয় তহবিল ১ এমডিবি ওয়ান তথা ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহ্যাডের লুণ্ঠিত তহবিলের বেশিরভাগই তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। দুর্নীতির জন্য তিনি এখন ১২ বছরের কারাভোগ করছেন। আনোয়ার ইব্রাহিমও প্রায় এক দশক জেল খেটেছেন। কিন্তু পার্থক্য হলো, তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ও অর্থমন্ত্রিত্বের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ দাঁড় করানো হয়।

এখন প্রশ্ন- ৭৫ বছর বয়সী আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এর আগে তিনি যে কার্যকর নীতি গ্রহণ করেছিলেন, এখন সেটি পারবেন কিনা। চ্যালেঞ্জ কেবল মহামারিপরবর্তী টেকসই পুনরুদ্ধারই নয়; উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি ঠেকানো এবং বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ হ্রাসের রাশ টানাও। এ সংকট মোকাবিলায় মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা ও ঋণের বোঝা কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। তা ছাড়া সামাজিক ব্যয়েও সংস্কার প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন মালয়েশিয়ার শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ। এ খাতে তহবিল জোগাতে সরকারের উচিত হবে ভর্তুকি যৌক্তিক করে এবং সংস্থান ও পরিষেবা নিশ্চিত করে রাজস্ব ফাঁকি কমানো। ঐতিহাসিকভাবে মালয়েশিয়ায় জাতিকেন্দ্রিক বাজেট প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এখনে তার বদলে প্রয়োজনভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

মালয়েশিয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগও জরুরি। দেশটির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করলে এটি মালয়েশিয়াকে উচ্চমূল্যের বিনিয়োগের দেশ হতে পারে। বেসরকারি বিনিয়োগের (বিদেশি বা অন্য কারও) জন্য প্রণোদনা যেমন প্রয়োজন, তেমনি শ্রমিকের জীবনযাপন উন্নয়নের নিশ্চয়তা এবং এমন বাণিজ্য নীতি জরুরি, যেটি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এটি অনুমিত, ভবিষ্যতের বিদেশি বিনিয়োগ সেই নীতির সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ হবে যেটি ২০২১ সালের এপ্রিলে জাতীয় বিনিয়োগ কাঠামো হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।

আরও অধিক বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ছাড়াও আনোয়ার ইব্রাহিম সরকারের উচিত মালয়েশীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ক্ষমতা বাড়ানোর প্রতি নজর দেওয়া। দেশীয় কোম্পানিকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক শিল্পের মানদণ্ডে গড়ে তুলতে পারলে মালয়েশিয়ার পুরো অর্থনীতি উপকৃত হবে। কিন্তু একেবারে শূন্য অবস্থায় স্থানীয় শিল্পের এমন উত্তরণ প্রায় অসম্ভব। সে জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশীদারিত্বে কাজের মাধ্যমে জ্ঞান, প্রাযুক্তিক বিষয় ও পুঁজির বিষয়ে ধারণা অর্জন হবে গুরুত্বপূর্ণ।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়াকে রপ্তানিমুখী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাজারমুখী সংস্কার, যেমন ট্যারিফমুক্ত ব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করা প্রয়োজন। মালয়েশিয়ার সরকারকে একই সঙ্গে অনুমোদন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার। কৃষি সংক্রান্ত আমদানির ক্ষেত্রে লাইসেন্স পদ্ধতির বিলোপ করলে তা মালয়েশিয়ায় খাদ্যের দাম কমাতে সাহায্য করবে।

আনোয়ার ইব্রাহিম সরকারের জন্য একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আমলা, রাজনীতিবিদ ও জনশক্তি খাতের ‘লৌহ ত্রিভুজ’ ভাঙা। এর ফলে শ্রমিক নির্যাতন, শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার হয়ে থাকে। যার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে মালয়েশিয়ার অভিবাসী শ্রমিক বাজারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশটির রপ্তানি খাত ইতোমধ্যে ব্যাপক শ্রমিক সংকটে ভুগছে। মালয়েশিয়া যতক্ষণ তার শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত না করছে ততক্ষণ শ্রমিক সংকট কাটবে না এবং তাতে স্থানীয় ব্যবসা যেমন সমৃদ্ধ হবে না, তেমনি বৈদেশিক বিনিয়োগেও কাটবে না অচলাবস্থা।

ভালো খবর হচ্ছে, আনোয়ার ইব্রাহিমের নির্বাচনী ইশতেহারের ১০ দফায় সব না এলেও এসব অগ্রাধিকারের অনেক কিছুই রয়েছে। কিন্তু সাধারণত যেটা দেখা যায়, নির্বাচনী প্রচারণার সময়কার অনেক প্রতিশ্রুতিই অপূর্ণ থেকে যায়। মালয়েশিয়ার অর্থনীতির সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নির্ভর করবে আনোয়ার ইব্রাহিমের শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার বজায় রাখার সক্ষমতা দেখানোর ওপর। এটা এতটা সহজ নয়। কারণ তাঁর সরকার পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সম্মিলনে গঠিত।

তবে আনোয়ার ইব্রাহিম তাঁর প্রথম রাজনৈতিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁর সরকার পার্লামেন্টে আস্থা ফেরাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের একতা টেকসই করতে তাঁকে সতর্কভাবে বিজেতা ও বিজিত সবার মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। এখন পর্যন্ত নির্বাচনী ইশতেহারে তাঁর যে অঙ্গীকার; তা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সে অঙ্গীকার বজায় রাখার মাধ্যমে আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন। এখন পরবর্তী ধাপ হবে তাঁর এ ইশতেহার পরিমার্জিত করা। সে জন্য প্রয়োজন হবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিসহ নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংলাপ করা। মালয়েশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সাবাহ ও শারাওয়াকের প্রতিনিধিত্ব নতুন সরকারে গ্রহণের মাধ্যমে আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীভূত হওয়ার এক ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এখন মালয়েশিয়া নিঃসন্দেহে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আনোয়ার ইব্রাহিমের চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই; আগেই বলা হয়েছে তাঁর অর্থমন্ত্রী হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালনেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে জন্যই মনে হচ্ছে, টেকসই প্রবৃদ্ধি, সামষ্টিক সমৃদ্ধির নতুন প্রভাব সম্ভবত মালয়েশিয়ার সামনে।

এম. নিয়াজ আসুদুল্লাহ ও অ্যান্ড্রু কাম জিয়া ই: লেখকদ্বয় যথাক্রমে মনাশ ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ইউনিভার্সিটি কেবানসান মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব মালয়েশিয়ান অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক; ব্যাংকক পোস্ট থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.