আনোয়ারুল আজীমকে খুনের জন্য ‘কলকাতায় ফ্ল্যাট ভাড়া নেন আক্তারুজ্জামান’

0
72
আনোয়ারুল আজীম ও আক্তারুজ্জামান

কমপক্ষে এক মাস আগে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে (আনার) খুনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি শুরু হয়। এতে জড়িত অন্তত তিনজন ঘটনার ১৩ দিন আগে বাংলাদেশ থেকে ভারতের কলকাতায় যান। তারও আগে যান দুজন। আনোয়ারুলকে হত্যার জন্যই সেখানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করা হয়।

খুনিদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে ১৩ মে রাতে খুন করা হয় আনোয়ারুলকে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, স্বর্ণ চোরাচালানের আন্তর্দেশীয় চক্রের দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে আনোয়ারুলকে ভারতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহিন নামের এক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কলকাতার নিউ টাউনে যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, সেটি এই আক্তারুজ্জামানের ভাড়া করা। তিনি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই।

কলকাতার পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নিউ টাউনের ওই ফ্ল্যাট (ট্রিপলেক্স) নাজিয়া বানু নামের এক নারীর কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলেন মো. আক্তারুজ্জামান। নাজিয়ার স্বামী সন্দ্বীপ রায় ওই ফ্ল্যাটের প্রকৃত মালিক। তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আবগারি দপ্তরের কর্মকর্তা। গত ২৫ এপ্রিল ফ্ল্যাট ভাড়ার চুক্তিপত্র সইয়ের পর ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামানকে ফ্ল্যাটটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এ তথ্য নাজিয়া কলকাতার নিউ টাউন থানা পুলিশকে দিয়েছে।

আক্তারুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ খুঁজছে। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি গত সোমবার ঢাকা থেকে একটি ফ্লাইটে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু চলে গেছেন।

এ ঘটনার তদন্তে নেমে বাংলাদেশ ও কলকাতার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন তথ্য পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দুই দেশের তদন্তকারীদের মধ্যে তথ্য বিনিময় হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ইতিমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে; যাঁরা ঘটনার পর ভারত থেকে দেশে ফিরেছিলেন। ঢাকায় ডিবির সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার তিনজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করছেন যে তাঁরা সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যায় সরাসরি জড়িত।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ও আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডিসহ আন্তর্দেশীয় বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার তথ্য রয়েছে। দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বলে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন।

এ ছাড়া আনোয়ারুল ভারতে গিয়ে যে বন্ধুর বাসায় উঠেছিলেন, সেই গোপাল বিশ্বাসও স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। আবার, সংসদ সদস্য আনোয়ারুলের বিরুদ্ধেও চোরাচালানসহ অন্তত ২১টি মামলা ছিল। যদিও পরে সেসব মামলা থেকে তিনি খালাস বা অব্যাহতি পেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোল রেড নোটিশও জারি করেছিল। অবশ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে সেটা তুলে নেওয়া হয়।

পুলিশ জানতে পারে, আক্তারুজ্জামান ও আনোয়ারুল আজীম পুরানো বন্ধু। আক্তারুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে। ঢাকায় গুলশানে আক্তারুজ্জামানের বাসা রয়েছে। তাঁর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে তাঁর বাসা।

হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কলকাতার ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার সময় আক্তারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ব্যবহার করেছিলেন; যা ভাড়ার চুক্তিপত্রেও উল্লেখ আছে।

যেভাবে খুন হন আনোয়ারুল

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ১২ মে কলকাতায় যাওয়ার পর আনোয়ারুলকে কৌশলে ওই ভাড়া করা ফ্ল্যাটে নেওয়া হয়। ওই দিনই সেখানে আনোয়ারুলকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ কয়েক টুকরা করে ব্যাগে ভরে সরানো হয়। এই ক্ষেত্রে স্থানীয় কারও সহায়তা নেওয়া হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পায়নি পুলিশ। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত লাশের সন্ধান পায়নি কলকাতা পুলিশ।

বিভ্রান্ত করার চেষ্টা

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আনোয়ারুলকে খুনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বজনদের বিভ্রান্ত করতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন খুনিরা। তাঁরা আনোয়ারুলের মুঠোফোন নম্বর থেকে একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিতে থাকেন। এমনকি মুঠোফোন নেটওয়ার্কের অবস্থানও পরিবর্তন করতে থাকেন। এ কারণেই নিখোঁজের ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ জানায়, ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থা দুই দফায় তাঁর মুঠোফোন নম্বর ভারতের দুটি রাজ্যে সচল হওয়ার তথ্য পেয়েছে।

আনোয়ারুল ১৩ মে রাতে খুন হন। অথচ সেই রাতে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকে বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়, বিশেষ কাজে তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। সেখানে পৌঁছে তিনি ফোন করে গোপাল বিশ্বাসকে জানাবেন, গোপাল বিশ্বাসের ফোন করার দরকার নেই।

এরপর ১৫ মে স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ২১ মিনিটে আনোয়ারুল আজীমের নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আরেকটি বার্তা আসে। তাতে আনোয়ারুল আজীমের দিল্লি পৌঁছানোর কথা জানিয়ে বলা হয়, ‘আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন, ফোন করার দরকার নেই।’ আনোয়ারুল আজীমের নম্বর থেকে একই বার্তা বাংলাদেশে তাঁর বাড়ির লোকজন এবং ব্যক্তিগত সহকারীকে পাঠানো হয়। এরপর ১৬ মে আনোয়ারুলের নম্বর থেকে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রউফের নম্বরে একটি ফোন আসে বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই হত্যার ঘটনা সম্পর্কে গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, কালীগঞ্জের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের হত্যাকাণ্ডটি পারিবারিক, আর্থিক নাকি অন্য কোনো কারণে, সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ডিবি নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে।

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.