
ঘড়ির কাঁটায় তখন চারটা। পুলিশের একটি গাড়ি এসে থামে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের প্রধান ফটকের সামনে। প্রথমে পুলিশের গাড়ি থেকে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান ওরফে রিয়াদকে নামিয়ে সিএমএম আদালতের সিঁড়ির কাছে নেওয়া হয়। গণমাধ্যমকর্মীদের দেখামাত্র আবদুর রাজ্জাক তাঁর ডান হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন।
আর রাজ্জাকের পিঠে মুখ ঢেকে রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহিম হোসেন (মুন্না), আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাব।
রাজ্জাকসহ চারজনকে যখন নিচতলার সিঁড়ি থেকে থেকে দুইতলায় নিয়ে যাওয়া হয়, তখন অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন সাধারণ আইনজীবীসহ অনেকে তাঁদের দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কোনো কোনো আইনজীবী তাঁদের মারধরের চেষ্টাও করেন।
এ সময় আবদুর রাজ্জাক, ইব্রাহিম, সিয়াম ও সাদাব পুলিশের পিঠের ওপর মুখ রাখার চেষ্টা করেন, যাতে তাঁদের মুখ দেখা না যায়। যখন তাঁরা পুলিশ সদস্যদের পিঠে মুখ রাখতে পারছিলেন না, তখন হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন।
এ সময় সাধারণ মানুষসহ আইনজীবীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর রাজ্জাকের উদ্দেশে সমস্বরে বলতে থাকেন, ‘এই চাঁদাবাজ, এই চাঁদাবাজ…।’
রাজ্জাকসহ অন্যরা যখন নিজেদের মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করছিলেন, তখন কয়েকজন আইনজীবী একযোগে তাঁদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘এই মুখ ঢেকে রাখিস কেন…?’ এ সময় একজন আইনজীবী চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘তোরা জুলাই চেতনা বিক্রি করে চাঁদাবাজি করেছিস…।’
রাজ্জাকদের হাঁটিয়ে যখন আদালত ভবনের প্রথম তলা থেকে চারতলায় নেওয়া হয়, তখন সাধারণ আইনজীবীদের কেউ কেউ তাদের উদ্দেশে নানা কটূক্তি করতে থাকেন।
ঢাকার সিএমএম আদালতের চারতলায় যখন পুলিশ রাজ্জাকদের কাঠগড়ায় নিয়ে যায়, তখনো ৩০ থেকে ৪০ জন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকসহ চারজনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁদের যখন কাঠগড়ায় তোলা হয়, তখনো রাজ্জাকসহ অন্যরা নিজেদের হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে আইনজীবীরা এজলাসকক্ষে এসেও রাজ্জাকদের চাঁদাবাজ আখ্যায়িত করে শাস্তি দাবি করেন।

‘চাঁদাবাজির গডফাদার কে?’
বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে ঢাকার সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল সিএমএম জিয়াদুর রহমান এজলাসে আসেন। তখন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রাজ্জাকসহ চার আসামিকে ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান। আদালতকে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘মাননীয় আদালত, মামলার আসামি আবদুর রাজ্জাকসহ অন্যরা সঙ্ঘবদ্ধ চাঁদাবাজ দলের সদস্য। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে আবদুর রাজ্জাকসহ অন্যরা ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে গুলশান, বারিধারাসহ অভিজাত এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট (নিশানা) করে চাঁদাবাজি করে আসছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ জুলাই সকাল ১০টার সময় সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় আবদুর রাজ্জাক ও কাজী গৌরব অপু উপস্থিত হন। বাসায় তখন শাম্মী আহমেদ উপস্থিত ছিলেন না। বাসায় ছিলেন তাঁর স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর। আবু জাফরকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন রাজ্জাক ও গৌরব। টাকা চাওয়ার পাশাপাশি তাঁরা স্বর্ণালংকারও চেয়েছিলেন।’
গুলশান থানার পরিদর্শক মোখলেছুর আদালতকে আরও বলেন, ‘চাঁদার টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে রাজ্জাক ও গৌরব তাঁদের আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করার হুমকি দেন। তখন মামলার বাদী নিজের কাছে থাকা পাঁচ লাখ টাকা ও তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করে তাঁদের (রাজ্জাক ও গৌরব) হাতে ১০ লাখ টাকা তুলে দেন।’

পুলিশ কর্মকর্তা মোকলেছুর রহমান আদালতকে আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, মামলার বাদীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার দুদিন পর আবার বাদীর বাসায় হাজির হন রাজ্জাক ও গৌরব। রাজ্জাক ও গৌরব তখন বাদীর ফ্ল্যাটে ধাক্কা মারতে থাকেন। তখন বাদী পুলিশকে বিষয়টি জানান। রাজ্জাক ও গৌরব বিষয়টি বুঝতে পেরে সেদিন ওই বাসা থেকে চলে যান। এর পাঁচ দিন পর গতকাল শনিবার বিকেলে সিদ্দিক আবু জাফরের বাসায় আসেন রাজ্জাক ও গৌরব। বাদী তখন বাসায় ছিলেন না। তখন চাঁদার বাকি ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন রাজ্জাক, গৌরবসহ অন্যরা। খবর পেয়ে পুলিশ রাজ্জাকসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোখলেছুর রহমান আদালতকে জানান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী গৌরব যে বাদীর বাসায় গিয়ে চাঁদা দাবি করেছিলেন, সেই ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। এই চাঁদাবাজির ‘গডফাদার’কে খুঁজে বের করার জন্য রাজ্জাকসহ চারজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।

পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকার সিএমএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা সুমন আসামিদের রিমান্ডে নেওয়ার পক্ষে আরও যুক্তি তুলে ধরা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, এটি কোনো সাধারণ চাঁদাবাজির মামলা নয়। গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে রাজ্জাকসহ অন্যরা রাজধানীর গুলশান, বনানীসহ গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকায় গিয়ে অভিজাত লোকেদের তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে তাঁরা টার্গেট করে চাঁদাবাজি করতে থাকেন দিনের পর দিন। অথচ এই আবদুর রাজ্জাকসহ অন্যরা ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাজে মন্তব্য করেছেন।’
পিপি শামছুদ্দোহা আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আওয়ামী লীগের নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় গিয়ে যে চাঁদাবাজি করেছেন, এর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। রাজ্জাকদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যাবে, ৫ আগস্টের পর থেকে তাঁরা কত কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন! এই চাঁদাবাজির টাকা তাঁরা কোথায় রেখেছেন? চাঁদাবাজির নেপথ্যে করা রয়েছেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়েছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। কিন্তু এসব চাঁদাবাজ চাঁদাবাজি করে উদোর পিন্ডি বুদৌর ঘাড়ে ফেলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন।’

পিপি শামছুদ্দোহা বলেন, ‘এই যাঁরা চাঁদাবাজ, এদের বয়সই বা কত, এই বয়সেই কেন কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করতে হবে? এই চাঁদাবাজদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।’
সরকারি এই আইনজীবী যখন রাজ্জাকদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন আদালত কক্ষে উপস্থিত আইনজীবীরা তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছিলেন। এ পর্যায়ে পিপি শামছুদ্দোহা বলেন, ‘এই চাঁদাবাজদের মূলহোতা কে বা কারা, সেটি বের করার জন্য তাঁদের সর্বোচ্চ ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক।’
পিপির বক্তব্য শেষ হওয়ার পর বাদী পক্ষে বেশ কয়েকজন আইনজীবী আদালতকে বলতে থাকেন, এই চাঁদাবাজরা দেশের শত্রু। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর রাজ্জাকের আইনজীবী আক্তার হোসেন ভূঁইয়া আদালতকে বলেন, তাঁর মক্কেল নিরপরাধ। তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। রাজ্জাকসহ অন্যরা কেউ আদালতে কথা বলেননি।
প্রায় ৪৫ মিনিট উভয় পক্ষের শুনানি শেষ হলে আদালত রাজ্জাকসহ চারজনকে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন।
পরে রাজ্জাকদের কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় আদালতকক্ষ থেকে হাজতখানায় নেওয়া হয়। তখনো একদল আইনজীবী রাজ্জাকদের চাঁদাবাজ হিসেবে আখ্যায়িত করে নানা কটূক্তি করতে থাকেন। এ সময় রাজ্জাকসহ অন্যরা নিজেদের মুখ ঢেকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তাঁদের প্রত্যেকের দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছিল পুলিশ।
আসাদুজ্জামান
ঢাকা