আতঙ্কের নতুন নাম রাসেলস ভাইপার, দ্রুত বাড়ছে বিস্তৃতি

0
42

রাসেলস ভাইপার। দেশে যত বিষধর সাপ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক বিষ এর। দংশনের সময় ঢেলে দেয় সর্বোচ্চটুকু। মূলত বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ বলে এর পরিচিতি থাকলেও এখন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে সাপটির আতঙ্ক। অথচ, মাত্র এক দশক আগেও তেমন একটা শোনা যেত না রাসেলস ভাইপারের নাম। মনে করা হচ্ছিল বিলুপ্তপ্রায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছরে বিস্তৃতিই শুধু বাড়েনি সাপটির; বেড়েছে অভিযোজনের ক্ষমতাও। ফলে, যে অঞ্চলগুলোর মানুষ রাসেলস ভাইপার নামই শোনেনি, সেখানেও এখন ঘন ঘন দেখা মিলছে সাপটির। আতঙ্কের মাত্রা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে উপযুক্ত অ্যান্টি ভেনমের অপ্রতুলতা।

জানা গেছে, দেশে যে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায়, তা শুধুমাত্র চার ধরনের সাপের দংশনের পর ব্যবহার হয়। রাসেলস ভাইপারের দংশনে এটি তেমন কাজ করে না। রাসেলস ভাইপারের ভেনম তৈরিতে গবেষণা শুরু হলেও সফলতা আসেনি এখন পর্যন্ত। দেশের বেসরকারি কোনো ওষুধ কোম্পানিও অ্যান্টি ভেনম বানায়নি। একমাত্র ইনসেপ্টা ভারত থেকে সীমিত পরিমাণ অ্যান্টি ভেনম আমদানি করে অর্ডার অনুযায়ী। এ অবস্থায় রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার হয়ে অনেকটা চিকিৎসার অভাবেই বরণ করে নিতে হচ্ছে মৃত্যু। কোনভাবে বেঁচে গেলেও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে ফুসফুস ও কিডনির।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সাপের প্রজননকাল চলছে, তাই দেখাও যাচ্ছে বেশি। তবে রাসেলস ভাইপারের অভিযোজন ক্ষমতা অনেক। ‘রাসেলস ভাইপারের পুনরাবির্ভাব ও মানুষের ঝুঁকি’ বিষয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান। তিনি বলেন, রাসেলস ভাইপারের নির্দিষ্ট কোনো প্রজননকাল নেই; বংশবিস্তার করতে পারে বছরের যেকোনো সময়ই। তবে মে থেকে পরের তিন মাস সাপটির প্রজননের হার সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া, ডিম না পেড়ে বাচ্চা দেয় সাপটি। ফলে, বংশবিস্তারও হয় দ্রুত। স্থল ও জল, দুই মাধ্যমেই স্বাচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে ভয়ানক বিষধর এ সাপটি। তাই বর্ষাকালে কচুরিপানার সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে নিজের স্থানান্তর ঘটাতে পারে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, ভয়ানক এই রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি আছে ভারত, ভুটান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন ও মিয়ানমারে। এ সাপ সাধারণত ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের ক্ষেতে বাস করে। বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে যাওয়াটাও লোকালয়ে এদের আবির্ভাবের বড় একটা কারণ।

 

গাজীপুরের শেখ কামাল ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের সরীসৃপ-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ সোহেল রানা বলেন, রাসেলস ভাইপার বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ বলেই পরিচিত ছিল। এটি মূলত শুষ্ক জায়গার সাপ। ধানের মৌসুমে বরেন্দ্র অঞ্চলের ফসলি মাঠগুলোতে ইঁদুর খেতে এই সাপের আনাগোনা ছিল বেশি। এখন এসব এলাকায় বছরের অন্য সময়েও ফসল হচ্ছে। ফলে ইঁদুর বাড়ছে; সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে রাসেলস ভাইপারও।

সোহেল রানা বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতাও বেড়েছে রাসেলস ভাইপারের। ফলে শুষ্ক অঞ্চল থেকে কচুরিপানার মতো যেকোনো ভাসমান কিছুর সঙ্গে ভেসে এটি নদীর ভাটির দিকে চলে যেতে পারছে। মূলত পদ্মা অববাহিকা ধরে এর সংখ্যা বাড়লেও এখন দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায় রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। হাতিয়া, ভোলায়ও এই সাপ দেখা গেছে।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের বাস্তব প্রমাণ, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছাড়িয়ে এখন পূর্বাঞ্চল ও অন্যান্য অঞ্চলেও দেখা মিলছে সাপটির। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে পদ্মার অববাহিকায়। গত তিন মাসে শুধু মানিকগঞ্জেই সাপটির দংশনে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচজন। রাসেলস ভাইপার আতঙ্কে ফসলের মাঠে কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছেন পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোর, নওগাঁ ও মেহেরপুরের অনেক কৃষক। সাপের দংশনের শিকার হলে বিস্তীর্ণ এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র ভরসা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এসব জেলা থেকে সেখানে যেতে লেগে যায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। আর চিকিৎসকদের বক্তব্য, সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিট অর্থাৎ ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মধ্যেই নিতে হয় অ্যান্টি ভেনম।

সম্প্রতি রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার হওয়ার পর সময়মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও বাঁচানো যায়নি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাকিনুর রহমান সাব্বিরকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, সাপের দংশনে রোগীর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি হলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়। কারণ, একেক দেশের সাপের প্রকৃতি, ধরন একেক রকম। ভারতে যেসব সাপ থেকে ভেনম সংগ্রহ করা হয়, সেগুলোর মাত্র ২০ শতাংশ বাংলাদেশের সাপের সঙ্গে মেলে। অথচ বছরের পর বছর ভারতে তৈরি অ্যান্টিভেনম দিয়েই বাংলাদেশে সাপের দংশনের শিকার রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে সাপের দংশনে মৃত্যু কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে দেশে বিচরণ করা সাপের বিষ থেকে অ্যান্টি ভেনম তৈরির জন্য গবেষণা চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে

ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, ‘আমাদের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রধান লক্ষ্য, বিষধর সাপ সংগ্রহ করা। তারপর তাদের লালন-পালন করা ও বিষ সংগ্রহ করা। বর্তমানে সাপের বিষ সংগ্রহের কাজ চলছে। আমাদের দেশের ১১ জাতের সাপের বিষ সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে দ্রুত অ্যান্টি ভেনম তৈরি সম্ভব নয়। এর প্রক্রিয়া অনেক লম্বা। এখন এ ভেনমের অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান। আবার এ ধাপের অনেক পরীক্ষা আমাদের দেশে হয় না। সম্প্রতি ডব্লিউএইচওর সহযোগিতায় কিছু ভেনম স্পেনের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। আমাদের ভেনমের স্বভাব চিহ্নিত করতে হবে।’

অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, আশির দশকেও সাপটি ছিল বাংলাদেশে। তবে তখন গবেষণা হতো না বলে মানুষের জানাশোনা ছিল কম। এখন চরাঞ্চল বা নদীর তীরবর্তী মানুষকে বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.