আওয়ামী লীগ বাদে অন্য প্রার্থীদের কেন ইসির প্রতি আস্থার অভাব

0
140
গাজীপুর সিটি করপোরেশন

গাজীপুরে তৃতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। প্রথমবারের মতো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ হবে।

নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে বাধা দেওয়া, হয়রানি ও হামলার মতো বিষয়ে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ জানানো হলেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি, এমন অভিযোগ উঠেছে। ইসি এবং প্রশাসনের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া অন্য মেয়র প্রার্থীদের। কাউন্সিলর পদেও ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্য দল থেকে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরাও প্রচারে বাধা ও হয়রানির অভিযোগ করছেন।

জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটির ভোটের দিকে সবার নজর রয়েছে। যদিও বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করছে। এখন পাঁচ সিটির মধ্যে প্রথম ভোট হতে যাচ্ছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে। সেখানেই নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার অভাবের কথা বলছেন ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্য মেয়র প্রার্থীরা।

দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুরে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। প্রায় ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৫০০ ভোটারের এই সিটিতে প্রথমবারের মতো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ হবে। গাজীপুরে ইভিএম নিয়ে প্রচার হয়েছে কম। বিপুলসংখ্যক ভোটারের মধ্যে ইভিএম নিয়ে আগ্রহের চেয়ে শঙ্কাই বেশি। ইভিএম নিয়ে সন্দেহও রয়েছে।

গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে যা ভাবছেন তরুণ ভোটাররা

প্রতীক বরাদ্দের পর গাজীপুর সিটি করপোরেশনে প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয় ৯ মে। দুই সপ্তাহের প্রচার শেষ হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১২টায়। প্রচারের সময় পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, কর্মীদের বাধা দেওয়া, গাড়িবহরে হামলার মতো ঘটনায় বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষ থেকে অন্তত ১৫টি অভিযোগ করা হয়। এর মধ্যে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের গণসংযোগে দুই দফায় হামলার অভিযোগ করা হয়।

নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং প্রচারণায় বাধার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে গত সোমবার চিঠি দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান। তাতে তিনি বলেন, ইসলামী আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এমন অবস্থা থাকলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না।

গাজী আতাউর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘প্রচারণার সময় নানাভাবে সরকারদলীয় প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের দ্বারা বাধার সম্মুখীন হয়েছি। বেশ কয়েকবার মৌখিক অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সর্বশেষ ৬টি ঘটনা উল্লেখ করে ২২ মে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু আজকে পর্যন্ত (গতকাল) কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।’ তিনি বলেন, ইসি দাবি করছে সুষ্ঠু ভোট হবে। কিন্তু ইসির কথায় তিনি আস্থা রাখতে পারছেন না।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপির ২৯ নেতা আজীবন বহিষ্কার

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন ৮ জন। দলের মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তবে যাচাই-বাছাইয়ে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। এরপর জাহাঙ্গীর আলম তাঁর মা জায়েদা খাতুনের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনকেই এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হচ্ছে। প্রচারের সময় জায়েদা খাতুনের জনসংযোগে দুবার হামলার অভিযোগ ওঠে। এ সময় গণসংযোগে ব্যবহৃত গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।

নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতার অভিযোগ তুলে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন গত রোববার বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে চিঠি দেন। চিঠিতে জায়েদা খাতুন অভিযোগ করেন, তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়েছে। এখন সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনও অযথা হয়রানি করছে। এসব বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।

তবে প্রার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম গতকাল  বলেন, প্রচার শুরুর পর থেকে বিভিন্ন প্রার্থীর কাছ থেকে ১৫টির মতো অভিযোগ পাওয়া গেছে। পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রচারে বাধা দেওয়ার মতো অভিযোগ ছিল। কয়েকজন প্রার্থীকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের গাড়িবহরে হামলার অভিযোগ করা হয়েছিল, সে ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।

ইভিএমের মতো নতুন পদ্ধতিতে ভোট হবে, তাতে সংশয় রয়েছে। অন্যদিকে গত দুই দিনে পুলিশি হয়রানির চিত্র দেখা গেছে বিভিন্ন ওয়ার্ডে, যা নতুন করে শঙ্কা সৃষ্টি করছে।

ইফতেখার শিশির, সাধারণ সম্পাদক, সুজন, গাজীপুর জেলা শাখা

বর্তমান সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহনুর ইসলাম মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। হাসান উদ্দিন সরকার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন।

মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলাম গতকাল অভিযোগ করেন, প্রচারের শেষ দিনেও তিনি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, টঙ্গীর পশ্চিম থানাধীন কাঁঠালদিয়া এলাকায় তাঁর গণসংযোগে বাধার সৃষ্টি করা হয়।

সরকার শাহনুর ইসলাম বলেন, ‘আমার মতো স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এজেন্ট দেওয়া। বেশ কিছু কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে পারছি না। কিছু কেন্দ্রে এজেন্টরা যেতে চাইছে না। নির্বাচন কমিশন এজেন্টদের কতটুকু নিরাপত্তা দিতে পারবে, এটা বড় প্রশ্ন।’

কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও নানা অভিযোগ

দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির বহিস্কৃত ২৯ জন নেতা কাউন্সিলর পদে অংশগ্রহণ করছেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে বিএনপি ২৯ জনকেই দল থেকে বহিষ্কার করেছে। এই কাউন্সিলর প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা প্রচারে বাধা, কর্মীদের হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করেছেন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও সদর থানা বিএনপির সদস্য ছিলেন তানভীর আহমেদ। দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পরও তিনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘সরকারি দলের কর্মীরা আমাদের নানাভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। আমাদের কর্মীদের হয়রানিসহ ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। সম্ভাব্য এজেন্টদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছে। নির্বাচনের দিন কেমন পরিস্থিতি থাকে, সেটাই দেখার বিষয়।’

ইভিএম নিয়ে ভোটারদের শঙ্কা

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের ৩ হাজার ৪৯৭টি কক্ষে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী প্রতিনিধি ও সাধারণ ভোটারের সঙ্গে কথা বলে । তাঁদের মতে, গাজীপুরের মানুষের ইভিএমে ভোট দেওয়া নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। অনেক প্রার্থী ও ভোটার ইভিএম সম্পর্কে অবগত নন। ভোটার উপস্থিতি ভালো হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোট গ্রহণ শেষ করা যাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তত ২০ জন ভোটারের সঙ্গে কথা বলেছে । ইভিএমকে পরিচিত করে তুলতে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগ পর্যাপ্ত ছিল না বলে তাঁদের অভিযোগ। ইভিএম নিয়ে গাজীপুরে প্রচারও কম হয়েছে। ভোটারদের মধ্যে ইভিএম নিয়ে আগ্রহের চেয়ে শঙ্কাই বেশি।

 নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আসিফ মোস্তফা বলেন, ‘এর আগে তো কখনো ইভিএমে ভোট দিইনি। ইভিএম নিয়ে কোনো প্রচার-প্রচারণাও চোখে পড়েনি। অন্য নির্বাচনে দেখেছি ইভিএমের বাটনে অন্য কেউ চাপ দিয়ে দেয়। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কী পরিস্থিতি হবে, বুঝতে পারছি না।’

এই বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বলেন, ইভিএমে ছোটখাটো যান্ত্রিক ত্রুটি হতে পারে। সেগুলো মাথায় রেখে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়েছে ইসি। গাজীপুর সিটিতে শ্রমিক, কৃষক, শহরের বাসিন্দাসহ বৈচিত্র্যময় ভোটার রয়েছেন। প্রান্তিক গোষ্ঠীর ইভিএমের বিষয়টি বুঝে ভোট দিতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। প্রতিটি কেন্দ্রে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা থাকবে, সেগুলো বসানোর কাজ প্রায় শেষ।

নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। এই সংগঠনের গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলেন, ইভিএমের মতো নতুন পদ্ধতিতে ভোট হবে, তাতে সংশয় রয়েছে। অন্যদিকে গত দুই দিনে পুলিশি হয়রানির চিত্র দেখা গেছে বিভিন্ন ওয়ার্ডে, যা নতুন করে শঙ্কা সৃষ্টি করছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.