ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে মতভেদ। অন্তর্বর্তী সরকার ও অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব দলটিকে জুলাই গণহত্যার জন্য দায়ী করে নির্বাচনে দেখতে চায় না। বিএনপি আগের মতোই সিদ্ধান্তের ভার জনগণের বললেও আওয়ামী লীগের অবস্থানে এসেছে নাটকীয় বদল। ক্ষমতাচ্যুত দলটি ১৪ বছরের বক্তব্য পাল্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে। অন্তর্বর্তী সরকার, ছাত্র নেতৃত্ব ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতি কঠোর মনোভাব দেখালেও বিএনপির প্রতি নমনীয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে দমনে কথা বললেও এখন একসঙ্গে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ইচ্ছার জানান দিচ্ছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা এবং ছাত্রদের দল গঠন নিয়ে কথা বলার পর আওয়ামী লীগও সেটাতে তাল দিচ্ছে। বিএনপির মতো করে বলছে, জনগণের নির্বাচিত সংসদ প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেই দিয়েছেন, বিএনপির ‘কথার টোন’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা কারও কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের একটি সফট ভার্সনকে ভোটের মাঠে আনার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এর পরিণতি ভালো হবে না।’
এ ভাষ্যকে নাকচ করে গতকাল শনিবার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘বিএনপিকে আওয়ামী শিবিরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। উনাদের কথাবার্তায় মনে হয়, বিএনপি যেন আওয়ামী লীগের দোসর। উদ্দেশ্যটা কী? বিএনপির গায়ে আওয়ামী লীগের সিল মারতে চান। আমাদের তাড়াতে চান, এই কথা কখনও চিন্তা করবেন না। পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, ভারতের দোসর আওয়ামী লীগ; তাদের দিকে যারা বিএনপিকে ঠেলে দিতে চায়, তারা চেহারা আয়নায় দেখুন।’
ছাত্র নেতৃত্বের বিশ্লেষণ, আওয়ামী লীগ ভোটের মাঠে না থাকলে নির্বাচন হবে ‘বিএনপি বনাম বাকিরা’। এতে সুবিধা হবে ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক দল ও জোটের। এবার ক্ষমতায় না এলেও অন্তত প্রধান বিরোধী দলে থাকবে। বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক সরকারের পাঁচ বছরের বেশি জনসমর্থন ধরে রাখার নজির নেই। তাই পরেরবার সুযোগ তৈরি হবে ছাত্র নেতৃত্বের। আওয়ামী লীগ থাকলে রাজনীতি আবার দ্বিদলীয় বৃত্তে ঢুকে যাবে। তৃতীয় শক্তির বিকাশের পথ রুদ্ধ হবে।
জামায়াতের একাধিক নেতারও একই মূল্যায়ন। তাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ মনে করে ছাত্র এবং জামায়াতের কারণেই তাদের পতন হয়েছে। তাই বিএনপির প্রতি নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। জামায়াতের এক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, অন্যদের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হওয়ায় আওয়ামী লীগ সুযোগ নিতে চাইছে। বিএনপির নেতারা এখন জামায়াত ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে কথা বলায় আওয়ামী লীগও একই সুরে কথা বলে আসলে বন্ধুত্ব পাতাতে চাইছে। এ সমীকরণ জানানোর পর জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, অভ্যুত্থানে অবদান রাখা কোনো দল বা জনগণ এগুলো মানবে না।
লুকিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বক্তব্য এবং তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি তাদের কাছে তুলনামূলক নিরাপদ। বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে কিছুটা হলেও স্থান পাবে। তাই সরকার, ছাত্র নেতৃত্ব ও জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়া বিএনপির অবস্থানকে আগ বাড়িয়ে সমর্থন দিচ্ছে। তবে নাম প্রকাশ করে কেউ বক্তব্য দেননি।
ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্পর্কে ‘কুকথা’ বললেও সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ তাঁর নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। গণতন্ত্র ‘পুনরুদ্ধারে’ বিএনপি এবং তারেক রহমানে সঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথা জানান।
সহানুভূতি পাওয়া এবং অভ্যুত্থানের শক্তিকে ভাগ করতেই আওয়ামী লীগের কৌশল বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, এতে কাজ হবে না। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সবচেয়ে বড় শিকার বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতির প্রশ্নই আসে না। বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কাউকে নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। বিএনপি মনে করে, আওয়ামী লীগের কী হবে, তা জনগণই ঠিক করবে।
তবে গতকাল চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘যারা বাংলাদেশপন্থি তাদের মধ্যে নির্বাচন হবে। বাংলাদেশবিরোধী, আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না।’
তিনি আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থি আখ্যা দিয়ে আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াত নির্বিশেষে যত রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন আছে, শ্রমিক, নারী, আলেম-ওলামা আছেন; যারা বাংলাদেশপন্থি সবাই বাংলাদেশে থাকবেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা ইতিবাচক প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন।
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের আকস্মিক পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ খ্যাতি পাওয়া মাহফুজ আলম বলেন, ‘সরকারের অগ্রাধিকারে রয়েছে খুনিদের বিচার, গুম-খুন, ধর্ষণের বিচার করা, সংস্কার করা এবং অবশ্যই বাংলাদেশপন্থি সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া, যা গত ১৬ বছরে সম্ভব হয়নি।’
শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করে নির্বাচন দাবির এক দিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগকে ভোটের বাইরে রাখার ঘোষণা দিয়ে মাহফুজ আলমের বক্তব্য গুরুত্ব পাচ্ছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার না করা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে পারবে না।
মোহাম্মদ আরাফাত নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে শুক্রবার লেখেন, ‘আগামী নির্বাচন ইউনূসের অবৈধ সরকারের অধীনে হবে না। এই গণশত্রু সরকারকে বিদায় নিতে হবে। একটি নতুন (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের অধীনে হতে হবে পরবর্তী নির্বাচন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল এবং ব্যক্তির জন্য যেন সমান সুযোগ থাকে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জনগণের নির্বাচিত সংসদ প্রয়োজনীয় সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। নির্বাচিত সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে, দ্বিতীয় বৃহত্তম দল সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসবে।’ এ লেখা আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড পেজে শেয়ার করায় দলীয় অবস্থান হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ দলগুলো ভোটে আগে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার চায়। দ্রুত নির্বাচন চাওয়া বিএনপি চায় ন্যূনতম সংস্কার করে ভোট হোক। নির্বাচিত সংসদ সংবিধানসহ অন্যান্য সংস্কার করবে। মোহাম্মদ আরাফাতও একই দাবি জানিয়েছেন। এ বক্তব্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগও অভিন্ন অবস্থান নিয়েছে বলে অভিমত অন্তর্বর্তী সরকার সূত্র এবং ছাত্র নেতৃত্বের।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন বলেন, বিচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হবে। মাহফুজ আলম সে কথাই বলেছেন। দলটির যারা ছাত্র-জনতাকে হত্যায় জড়িত তাদের রাজনীতি ও নির্বাচনের সুযোগ নেই। যদি কেউ সংসদে আওয়ামী লীগকে এনে একটি বহুদলীয় ব্যবস্থা দেখাতে চায়, তাহলে তাদের পরিণতি শেখ হাসিনার মতোই হবে। বিএনপি এক/এগারোর শিকার বলে তাদের এই ভূত তাড়া করে। বিএনপি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ছিল, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রয়েছে, ফ্যাসিবাদ নির্মূলে তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধান রেখে, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে তা হবে না।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, সরকারকে সফল করতেই সমালোচনা করা হচ্ছে। এতে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। সহ্য করতে হবে। সমালোচনা করলে পরবর্তীতে নেতাদের অপমান করা হয়। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আওয়ামী লীগের দোসররা নানা ষড়যন্ত্র করছে ঐক্যে ফাটল ধরাতে।
তবে আওয়ামী লীগ প্রশ্নে ছাত্র নেতৃত্বই নমনীয় বলে অভিযোগ করেছেন গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি সুযোগ পায়, তাহলে কাউকে ছাড়বে না। আওয়ামী লীগকে ফেরাতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এজেন্ট কাজ করবে, ফান্ড দেবে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে কোনো ছাত্রকে শক্ত অবস্থানে দেখছি না। এ বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক আন্দোলন চালানোর দরকার ছিল। কিন্তু বুঝতে পারছি না তারা কেন সুবিধাবাদী অবস্থানে আছে।
গত শুক্রবার তিন উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার দুই বিশেষ সহকারী অভ্যুত্থানের ৪০ শহীদের পরিবারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ কথা জানিয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বলেন, তাদের ন্যায্য দাবিগুলো হলো বিচার, পুনর্বাসন এবং ফ্যাসিবাদ যাতে ফিরতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কার। দাবি পূরণ না হওয়ার আগে তারা নির্বাচন হতে দেবেন না। এ সময় দাবি আদায়ে সচেষ্ট থাকার প্রতিশ্রুতি দেন উপদেষ্টারা।