বাংলাদেশে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার প্রয়াসে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারপ্রক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। ঢাকা সফরের প্রথম দিন তিনি সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় গুরুত্বারোপ করে সংস্কারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
ফলকার টুর্ক দুই দিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন। সফরের প্রথম দিনে মঙ্গলবার তিনি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। পাশাপাশি তিনি দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সঙ্গে এক মধ্যাহ্নভোজসভায় যোগ দেন। এরপর তিনি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। বিকেলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখেন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
জুলাই গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান কমিটি কাজ করছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। আমাদের প্রধান কার্যালয় পুরো বিষয় পর্যবেক্ষণ করছে।ফলকার টুর্ক, জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার
আইনের শাসন ও মানবাধিকারে জোর
সকালে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেন। বৈঠকের পর ফলকার টুর্ক সাংবাদিকদের বলেন, আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার নিয়ে তাঁর কথা হয়েছে। দুটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্তমান সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, এ ক্ষেত্রে মানবাধিকার যেন নিশ্চিত করা হয়।
ফলকার টুর্ক বলেন, ‘জুলাই গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান কমিটি কাজ করছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। আমাদের প্রধান কার্যালয় পুরো বিষয় পর্যবেক্ষণ করছে।’
আসিফ নজরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জাতিসংঘ তাদের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছে। ফলকার টুর্ক সরকারের সংস্কারকাজেও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি দুটি প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন—এক. বিচার বিভাগ স্বাধীন করা; দুই. মৃত্যুদণ্ড রহিত করা।
বিচার বিভাগ সংস্কার কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি জানানো হয়েছে উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে টুর্ক বেশি প্রশ্ন করেছেন। তিনি বলেছেন, মৃত্যুদণ্ড রহিত করার সুযোগ আছে কি না? আমরা বলেছি, বর্তমান বাস্তবতায় মৃত্যুদণ্ড রহিতের সুযোগ নেই। পেনাল কোডে (দণ্ডবিধি) মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা আছে। হুট করে এটা পরিবর্তনের সুযোগ নেই।’
যে ফ্যাসিস্ট সরকার হাজার হাজার শিক্ষার্থী মেরেছে, তাদের বিচারকে সামনে রেখে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার প্রশ্নই আসে না বলে উল্লেখ করেন আসিফ নজরুল। তিনি জানান, ফলকার টুর্ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে খসড়া চেয়েছেন। সরকার সেটি তাদের দেবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সব ধরনের আইনি অধিকার দেওয়া হবে বলেও আলোচনায় উল্লেখ করেন আসিফ নজরুল।
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় হবে
রাজধানীর একটি হোটেলে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজসভার পর সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সম্মতি দিয়েছে উল্লেখ করে শারমিন মুরশিদ বলেন, ‘শিগগিরই এই কার্যালয় হবে। এখানে কার্যালয় (জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ) থাকা মানে মানবাধিকারের জায়গা থেকে আমাদের শক্তি বাড়ল।’
শারমিন মুরশিদ বলেন, যে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসে, চলে যায়, তারা যদি নিজেদের অপরাধের তদন্ত করে, সে তদন্ত তো হয় না। নাগরিক সমাজ থেকে যখন তদন্ত করা হয়, অথবা সত্যটা যখন তুলে ধরা হয়, তখন তাঁদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে এবং নানা চাপের মুখে থাকতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকে যাঁর যাঁর ক্ষেত্র থেকে বলেছি, চ্যালেঞ্জগুলো কী এবং তারা (জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ) কোথায় আমাদের পাশে দাঁড়াতে পারে।’
পুলিশের সংস্কারে মানবাধিকার ইস্যু
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে মানবাধিকার ইস্যুতে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। পুলিশের সংস্কার কার্যক্রমসহ গণ–অভ্যুত্থানের সময় ভিকটিম ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে বলেছেন ফলকার টুর্ক।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে প্রতিনিধিদল জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের পাঠানোর ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে যাচাই-বাছাই করে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছে। তবে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ যে ভালো করছে, সে বিষয়ে তারা প্রশংসা করেছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনে মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি যেন গুরুত্ব পায়, সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে সহিংস পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আরও কিছু রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণে আমরা চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছি।’