আইনি ও রাজনৈতিক বেড়াজালে আটকা

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা

0
154
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

গুরুতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টি আইনি ও রাজনৈতিক বেড়াজালে আটকা পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও আইনি ব্যাখ্যা প্রদান।

সরকার বলছে, তাদের আর করার কিছু নেই। বিদেশে যেতে হলে খালেদা জিয়াকে যেতে হবে আদালতে। এমনকি আবার কারাগারেও যেতে হবে। অন্যদিকে, বিএনপি ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, আইনগতভাবে বিদেশে যেতে তাঁর কোনো সমস্যা নেই। আদালতে আবেদনেরও কোনো প্রয়োজন নেই। নির্বাহী আদেশেই তাঁকে বিদেশে পাঠানো সম্ভব। বিষয়টি মানবিকতার সঙ্গে দেখার অনুরোধ করেন তারা। আবার আইনজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী শর্ত পরিবর্তনে আইনগত কোনো বাধা নেই। এ পরিস্থিতিতে আজ রোববার বিষয়টি নিয়ে আইনি মতামত দেবে আইন মন্ত্রণালয়।

যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকারিভাবে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার জন্য যতটুকু করা সম্ভব তা তিনি করেছেন। এখন বিদেশে যেতে হলে তাঁকে আদালতে ও কারাগারে যেতে হবে। গতকাল শনিবার প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা আরও বলেন, সরকারের ক্ষমতা অনুয়ায়ী তাঁকে বাসায় থেকে দেশের সবচেয়ে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মিথ্যাচার করেছেন। খালেদা জিয়ার সংকটজনক অবস্থার জন্য সরকার দায়ী। এই সরকার অন্যায়ভাবে তাঁকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে আটকে রেখে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’

এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে তাঁর পরিবারের করা আবেদন পেয়েছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ আবেদনের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে। আমরা যাচাই-বাছাই শেষে রোববার আমাদের মতামত জানিয়ে দেব।’

খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ চেয়ে তাঁর ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার গত সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবারও আবেদন করেন। পরে মতামতের জন্য আবেদনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে ওই দিন সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে আইনের বিদ্যমান অবস্থা থেকে সরকারের আর কিছু করার নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১)-এর ধারার ক্ষমতাবলে শর্তযুক্তভাবে তাঁর সাজা স্থগিত রেখে শর্তযুক্ত মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায়। এখন আইনের যদি কোনো পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে খালেদা জিয়াকে দেওয়া শর্তযুক্ত মুক্তি আগে বাতিল করতে হবে। সেটি বাতিল করে আগের অবস্থায় যাওয়ার পর আবার অন্য বিবেচনা করা যাবে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে তাঁর ভাই একটি আবেদন করেছেন। কিন্তু এখানে আইনি জটিলতা রয়েছে। আমরা আবেদনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এর পর কিছু করতে হলে আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থায় যেতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া কয়েকটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, তিনি কারাগারে ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দণ্ডাদেশ স্থগিত করে বাসায় থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যাতে তিনি উন্নত চিকিৎসা পান, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী শর্ত পরিবর্তনে আইনগত কোনো বাধা নেই। সরকার বেশ কয়েকবার তাঁর কারামুক্তির মেয়াদ বর্ধিত করেছে। অর্থাৎ শর্ত পরিবর্তন করেছে।

অতএব বিদেশে চিকিৎসার জন্য নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া ঢাকায় থাকবেন এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করবেন– এই বাক্যে ঢাকা শব্দটা বাদ দিয়ে নতুন আদেশ জারি করতে আইনগত কোনো বাধা দেখি না।’

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানান, ‘খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু নতুন করে আবেদন করার কথা বলে সরকার সময়ক্ষেপণ করে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে আদালতের আদেশের প্রয়োজন নেই। সরকার নির্বাহী আদেশে তাঁকে অস্থায়ীভাবে মুক্তি দিয়েছেন। নির্বাহী আদেশে তাঁকে বিদেশ পাঠাতে পারেন।’

শারীরিক অবস্থার উন্নতি নেই

রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি নেই। শুক্রবার রাতে তাঁর লিভার থেকে পানি বের করার পর সিসিইউ থেকে তাঁকে কেবিনে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাঁকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। গতকাল তাঁর আলট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে বলে জানা গেছে। দ্রুত বিদেশের হাসপাতালে তাঁকে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

লিভার সমস্যার পাশাপাশি কিডনি জটিলতাও খালেদা জিয়াকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের লিভারের যে অবস্থা, তাতে তাঁর পুরো চিকিৎসা এদেশে সম্ভব নয়। তারা সাময়িক সময়ের জন্য সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া এ ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প নেই। লিভারের পাশাপাশি তাঁর ডায়াবেটিস উচ্চ পর্যায়ে। কখনও কখনও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ওষুধ দিয়ে একটি সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আরেকটি জটিল হয়ে ওঠে।

খালেদা জিয়ার দেখাশোনার জন্য সকাল-বিকেল তাঁর ছোট পুত্রবধূ হাসপাতালে আসা-যাওয়া করছেন।

গত কয়েক দিন ধরে খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর ব্যাপারে পরিবার খোঁজখবর ও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়। এ পরিস্থিতিতে সরকার নমনীয় বলে মনে করেছেন অনেকে। কিন্তু গতকাল শনিবার প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীদের বক্তব্যে সরকারের অনঢ় অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত হলো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.