সীমা অক্সিজেন প্লান্টে গত শনিবার বিস্ফোরণের পর থেকেই আঁধারে ডুবে আছে সীতাকুণ্ডের বেশ কয়েকটি এলাকা। টানা তিন দিন বিদ্যুৎ না থাকায় ১০ হাজারের বেশি মানুষের নানা ভোগান্তিতে দিন কাটছে। বন্ধ রয়েছে ২০টির বেশি ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দেখা দিয়েছে খাবার পানির তীব্র সংকট। বাধ্য হয়ে অনেকে খাচ্ছে পুকুরের পানি। কেউ কেউ এক কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে কলসি করে পানি এনে ব্যবহার করছে।
বিস্ফোরণে বিদ্যুৎ লাইনের অন্তত ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্ষতিগ্রস্ত সংযোগ মেরামতে কয়েক দিন সময় লাগতে পারে। বৃহস্পতিবারের আগে বিদ্যুৎ না মেলার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ব্যাপারে ফৌজদারহাট বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের প্রধান নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার শেখ কাউছার মাসুম বলেন, ‘বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ফলে বিদ্যুতের অটো লাইন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পুল হেলে পড়েছে। পুলের ইনসুলেটরও নষ্ট হয়ে গেছে। বিস্ফোরণে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিটি, পিটিসহ এইচটি মিটার। এসব সংস্কারে ৭০ লাখ টাকার মতো খরচ হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ লাইন মেরামতের কাজ গতকাল বিকেল থেকে শুরু হয়েছে।’
ফৌজদারহাট বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী এখলাছ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনায় আমাদের বিদ্যুতের অনেক সঞ্চালনা লাইন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় গলে গেছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন।’
এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে তদন্ত কমিটি। এ কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিবুল হাসান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ইয়ার সেপারেশন কলাম যেটি রয়েছে, সেখান থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। তারপরও সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ জন্য সংশ্লষ্ট সব পক্ষের কাছ থেকে বক্তব্য নেওয়া হবে। আশা করছি, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসল ঘটনা উঠে আসবে।’
সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ৭
এমডি, পরিচালকসহ ১৬ জনের নামে মামলা: সীমা অক্সিজেন প্লান্টের এমডি, পরিচালকসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে গত রাতে সীতাকুণ্ড থানায় মামলা করেছেন নিহত কাদের মিয়ার স্ত্রী রোকেয়া বেগম। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ। মালিকপক্ষের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এই প্লান্টে তাঁর স্বামীসহ সাতজন নিহত হয়েছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করেন তিনি। মামলাটি সীতাকুণ্ড মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আবু সাঈদ তদন্ত করবেন বলে জানিয়েছেন ওসি তোফায়েল আহমেদ।
সীমাহীন দুর্ভোগ: স্থানীয় বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। এতে চরম কষ্টে দিন কাটছে বাসিন্দাদের। বৃদ্ধ ও শিশুরা পড়েছেন বেশি বিপাকে।’ওষুধ ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন বলেন, ‘ফ্রিজে রাখা ওষুধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। টানা অনেক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।’গৃহিণী রোকেয়া আক্তার বলেন, ‘ফ্রিজে রাখা মাছ-মাংস নষ্ট হয়ে গেছে।’
খবর নিচ্ছে না মালিকপক্ষ: বিস্ফোরণে কেউ হারিয়েছেন হাত; কারও কেটে ফেলতে হয়েছে পায়ের নিচের অংশ। এখন তাদের ঠাঁই হাসপাতালের শয্যায়। চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন আহতরা। তবে যাঁদের গাফিলতি ও অবহেলায় এত বড় বিস্ফোরণ ঘটল; তারা একবারের জন্যও দেখতে যাননি আহতদের। ঘটনার তিন দিন পরও হাসপাতালে মালিকপক্ষের কাউকে কাছে না পেয়ে হতবাক আহত ও তাঁদের স্বজনরা। মিলছে না নানা মহল থেকে আশ্বাসের টাকাও। এ অবস্থায় আহতদের চিকিৎসা চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সামান্য আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোকে। চিকিৎসকরা বলছেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত বেশ কয়েকজনের প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার।
কারও উড়ে গেছে হাত, কারও গেছে পা
খবর নেওয়া ও আর্থিক সহায়তা বিষয়ে জানতে চাইলে সীমা অক্সিজেনের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবদুল আলীম বলেন, ‘সরকারি বিধি মোতাবেক আহত-নিহতদের আর্থিক সহায়তা ও ক্ষতিপূরণ দেব আমরা। সীমা গ্রুপের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আহতদের দেখাশোনা করছেন। তাঁদের আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তাও পর্যায়ক্রমে দেওয়া হচ্ছে।’চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘হতাহতদের পাশে আমরা আছি। মালিকপক্ষকে অবশ্যই তাদের ব্যয়ভার বহন করতে হবে। বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।’
মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হেরে গেলেন প্রবেশ: টানা দুই দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন প্রবেশ লাল শর্মা রোববার রাতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি সীমা অক্সিজেন কারখানায় অপারেটর ছিলেন। তাঁকে নিয়ে এই বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭-এ।
চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ১৭ জন চিকিৎসাধীন। আইসিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদ বলেন, ‘বিস্ফোরণে প্রবেশ লাল শর্মার মস্তিষ্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁকে নিয়েই আমাদের দুশ্চিন্তা ছিল বেশি।’