অভিনয় গুণেই দুলু থেকে ফারুক হয়ে উঠেছিলেন

0
145
ববিতা

সকালে আলমগীর ভাই [চিত্রনায়ক] ফোনে জানালেন খবরটি। বিশ্বাস হয়নি প্রথমে। তাঁকে বললাম, এটা মনে হয় গুজব। আজকাল প্রায়ই তো নানা গুজব ইউটিউবে দেখি। তিনি বললেন, ‘না– এটি সত্যি।’ তারপর দু’জনে ফোনের দুই প্রান্তে নিশ্চুপ ছিলাম কিছুক্ষণ। আমাদের সুদীর্ঘকালের বন্ধু, প্রিয় নায়ক ফারুক আর পৃথিবীতে নেই– এটি বিশ্বাস করে ওঠা আসলেই কষ্টকর। তিনি এতই প্রাণবন্ত, হাসিমুখের চিরতরুণ একজন মানুষ ছিলেন যে, তিনিও বিয়োগ হয়ে যাবেন জীবন থেকে, এই কঠিন সত্য মেনে নিতে মন চায় না।

তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ভালো হয়ে যাবেন, এমন প্রত্যাশা ছিল। ক’দিন আগেই তাঁর স্ত্রী ফারহানার বোনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। বললেন, ফারুক ভাইয়ের রক্ত সঞ্চালনে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। পায়ে বেলুনিং করতে হবে। তিনি ঠিকঠাক আছেন। শুনে খুব খুশি হলাম। শিগগির ঢাকায় ফিরবেন তিনি। কিন্তু আজ জানতে পারলাম, ফারুক ভাই চলে গেলেন!
নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ সিনেমায় ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে প্রথমবার অভিনয় করি। সিনেমায় তাঁর ছোট একটি চরিত্র ছিল। ওই সিনেমার সেটেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। প্রথম ততটা চেনাজানা ও বন্ধুত্ব না থাকলেও চলচ্চিত্রে একসঙ্গে কাজের সুবাদে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর প্রায় ৪০টির মতো সিনেমায় তাঁর বিপরীতে কাজ করেছি। বেশিরভাগ ছবিই দর্শকপ্রিয়তা পায়। ‘নয়ন মনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘লাঠিয়াল’, ‘মিয়াভাই’, ‘সূর্য সংগ্রাম’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘এতিম’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’সহ অসংখ্য সুপারহিট সিনেমায় দর্শক ববিতা-ফারুক জুটি দেখেছেন। এর পরের ইতিহাস তো সবারই কমবেশি জানা।

মনে পড়ে, গোলাপী এখন ট্রেনে সিনেমার দৃশ্যধারণ হয়েছিল মানিকগঞ্জের ফকিরবাড়ী, নবগ্রাম, ঝিটকা এলাকার নদীর পাড়ে। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে সেই শুটিং করতাম, অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম, কখন আমাদের শট আসবে। কত কত স্মৃতি! সব চোখে জ্বলজ্বল করছে।
ফারুক ভাই পাখি শিকার করতে পছন্দ করতেন। বন্দুক নিয়ে খুব সকালে বের হয়ে জঙ্গলে যেতেন। পাখি এনে বাবুর্চিকে রান্না করতে বলতেন। তাঁকে বললাম, ‘আপনি পাখি শিকার করছেন। আমি তো কিছুই পারি না।’ আব্বুর কিনে দেওয়া একটি এয়ারগান বাসায় ছিল। এটি নিয়ে প্রায়ই আউটডোর শুটিংয়ে যেতাম। একদিন ফারুক ভাইকে বললাম, ‘আজ আমি পাখি শিকার করব।’ তিনি হাসলেন। শুটিংয়ের এক ফাঁকে কাজের মেয়েকে নিয়ে জঙ্গলে চলে গেলাম। একসঙ্গে তিনটি পাখি শিকার করেছিলাম। দেখে ফারুক ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন। বললাম, ‘আপনি একাই পারেন? আমরা কী পারি না!’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আপনি ঝড়ে বক মেরেছেন। ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে। এগুলো একসঙ্গে অনেক থাকে। আপনি আন্দাজে ট্রিগার টিপেছেন। আর দু-তিনটা মাটিতে পড়ে গেছে!’ আমি লজ্জায় মুখ লুকালাম।

ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে অনেক স্মরণীয় সিনেমায় কাজের সুযোগ হয়েছে। ১৯৭৬ সালে ‘নয়ন মনি’ এ দেশের প্রেমের সিনেমার মধ্যে ধ্রুপদি হয়ে উঠেছে। এ সিনেমার পর ফারুক-ববিতা জুটি মানেই বিশেষ কিছু হয়ে ওঠে। মাসের পর মাস সিনেমাটি দেশের সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছে। কয়েক যুগ পরও আজও এই সিনেমার কথা মানুষ মনে করেন, কালজয়ী বোধহয় একেই বলে! আমাদের অভিনীত সিনেমার প্রেম, বিরহ আজও দর্শক হৃদয়ে মুগ্ধতাভরা হাহাকার জন্ম দেয়। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফারুক ভাই ও আমি দু’জন একসঙ্গেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হই। এক সময়ের সফল জুটি একসঙ্গে আজীবন সম্মাননা পাই– এটা পরম আনন্দের।

অভিনয় গুণেই তিনি ‘দুলু’ থেকে ফারুক হয়ে উঠেছিলেন। সব চরিত্রেই ছিলেন অনবদ্য। বিশেষ করে প্রতিবাদী গ্রামের যুবকের চরিত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। সিনেমার পর্দার মতো বাস্তবেও তিনি প্রতিবাদী ছিলেন। চলচ্চিত্রের প্রিয়জন নায়ক ফারুক এমন একটি নাম অভিনয় জগতে, যে নামের সঙ্গে একটি বর্ণাঢ্য অধ্যায় জড়িত। তাঁর মতো হাস্যোজ্বল, প্রাণখোলা, অমায়িক ও বন্ধুবৎসল মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি। বন্ধু, সহকর্মীদের জন্য তাঁর উদ্বেগ ও প্রচুর ভালোবাসা ছিল। নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যেতেন অন্যের উপকারে।

আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমরা জুটি বেঁধে একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। তখন আমাদের সদ্য তারুণ্য। সময় গড়িয়েছে, আমরা ক্রমশ পরিণত হয়েছি, আমাদের কাজ থেকে গেছে জানি, বাংলা চলচ্চিত্রে ফারুকের কাজ চিরস্থায়ী সম্পদ। তিনি নিজের কাজের গুণে অমর। তাঁর মৃত্যু নেই। দুঃখ এই, মানুষটিকে আর চোখে দেখব না। সেই প্রাণখোলা হাসির আমুদে মানুষটি। যিনি ছিলেন জাত অভিনেতা আর অসামান্য মানবিকতার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.