যদি নদীর কথা আসে, তাহলে দুশ্চিন্তার খবর আছে। ব্রহ্মপুত্রে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ বানাচ্ছে চীন। ব্রহ্মপুত্র ছিল পৃথিবীর একমাত্র বাঁধমুক্ত বড় নদী। চীনের তরফে ব্যাপারটা ঢেকে রাখা হয়েছিল অনেক দিন। কিন্তু স্যাটেলাইটের চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন। কারণ বাঁধের জায়গাটা ভূ-রাজনৈতিকভাবে নাজুক। এলাকাটি সংঘাতেরও জ্বালামুখ। চীনের তিব্বত আর ভারতের লাদাখের মধ্যে যে সীমান্তরেখা (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল-এলএসি), তার খুব কাছেই হচ্ছে এ বাঁধ।
সেখানটাতেই বাড়ছে চীন ও ভারতের সৈন্য সমাবেশ। এখানটাতেই ২০২০ সালে ভারতের অন্তত ২০ জন আর চীনের চারজন সৈন্যের প্রাণহানি ঘটে। এর পর আরও কয়েকটি ছোট মাপের সংঘাত হয়েছে। এ সপ্তাহেও দুই পক্ষের কমান্ডারদের বৈঠক সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয়েছে। এমন একটি ভূ-রাজনৈতিক তপ্ত ভূমিতে চীনের বাঁধ নির্মাণের অর্থ কী হতে পারে? বিশ্লেষকরা বলছেন, রেলপথ, হাইওয়ে, বাঁধ নির্মাণ– সবই এ অঞ্চল ঘিরে চীনের গভীর ও বিস্তারী পরিকল্পনার অংশ।
আমরা পৃথিবীর যে দিকটায় বসবাস করি, সেখানে ভাটির চাইতে উজানের দেশগুলোই বড়। যেমন বাংলাদেশের উজানের ভারত বড় রাষ্ট্র। আবার ভারতের চেয়ে আয়তনে বড় চীন এবং এসব দেশে নদী ভাগাভাগির মামলা কখনোই মীমাংসিত না।
এশিয়ার এ অঞ্চল নদীসভ্যতায় সমৃদ্ধ হলেও নদীর পানি বণ্টন সভ্য কায়দায় হয় না। চীন যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর জলপ্রবাহ আটকিয়ে বড় কাঠামো বানাবে, তা চীন ভারত বা বাংলাদেশকে অবহিত করেছে বলে জানা নেই। লাদাখের সংঘাতের পর ভারতকেও আর তথ্য দিচ্ছে না চীন। ভারতও অনেক সময় অবহিত করে না বাংলাদেশকে। পদ্মার উজানে গঙ্গায় বাঁধ দিয়েছে ভারত। তিস্তার পানিবঞ্চনার দুঃখ বাংলাদেশকে ভোগায়। এখন কাঁদাতে আসছে চীনের বাঁধ।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একে বলা হচ্ছে সুপারড্যাম। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি হবে চীনের বৃহত্তম থ্রি গর্জেস ড্যামের চেয়ে তিন গুণ এবং বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম। এখানে উৎপাদিত হবে ৬০ মিলিয়ন কিলোওয়াট অর্থাৎ ৬০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ। বিরাট দক্ষযজ্ঞ। তিব্বতের শান্নান জেলায় হতে থাকা বাঁধে ব্রহ্মপুত্রের পানি আটকিয়ে জলাভাবে থাকা উত্তর-পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে নেওয়ার কথা। তা হলে ভারত-বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষকে ভুক্তভোগী হতে হবে।
ইয়ারলাং সাংপো নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা চীন প্রথম বলে তার চতুর্দশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫) ও ২০৩৫ অভিমুখী দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্পে। গত বছরের অক্টোবরে পাওয়ারচায়না এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করে। বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। সে সময় চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পাওয়ারচায়না ঘোষণা করে, তারা এ রকম কিছু বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে এবং ইতিহাসে তা অভূতপূর্ব। তারপর ভারতীয় গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
পদ্মা ছাড়া বাংলাদেশের আরেক বৃহৎ নদীব্যবস্থা হলো ব্রহ্মপুত্র। হিমালয় পর্বতদেশের নদটি চীনের তিব্বত থেকে নেমে ভারতের অরুণাচল ও আসাম প্রদেশ হয়ে বাংলাদেশের একদম বুক চিরে প্রবাহিত। তিব্বতে এর নাম সাংপো, অরুণাচলে সিয়ং এবং আসাম ও বাংলাদেশে এর নাম ব্রহ্মপুত্র। কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে গোয়ালন্দের কাছে এটি পদ্মায় মিলেছে। এই ব্রহ্মপুত্রে এসে মিশেছে তিস্তা নদী– কুড়িগ্রামের চিলমারীতে এসে। নিম্ন-ব্রহ্মপুত্রই আবার যমুনা নাম নিয়ে দক্ষিণ দিকে ছুটেছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার রয়েছে চারটি প্রধান উপনদী: দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা ও করতোয়া– আত্রাই নদপ্রণালি। সাংপো-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা মিলিয়ে এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম নদ। পদ্মা ও মেঘনার চেয়ে এর শক্তি ও জলধারা অনেক বেশি। ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলেই বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ সুন্দরবন অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র তাই বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীব্যবস্থার প্রাণ। সেই প্রাণপ্রবাহে বাধা পড়লে কী হবে, ভাবা যায়?
তিব্বতের যে গিরিখাত দিয়ে ব্রহ্মপুত্র বয়ে যাচ্ছে, সেখানে নদটি প্রায় ৩ হাজার মিটার নিচে নেমে এসেছে। এই গিরিখাত দুর্গম; গভীরতায় যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দ্বিগুণ। পুরো অঞ্চল অমূল্য প্রাকৃতিক ও প্রতিবেশগত বৈচিত্র্যে ভরপুর। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অব্যবহৃত জলসম্পদ রয়েছে এখানে। এই নদের শক্তি ধারণক্ষমতাও সবার চেয়ে বেশি। সে কারণেই এতে যে কোনো হস্তক্ষেপ পরিবেশগত নাজুকতা নিয়ে আসবে। তাই এই নদের ওপর চীনের বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ বানানো মানে ভারতের অরুণাচল থেকে আসাম হয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত প্রতিবেশগত ঝুঁকি তৈরি হওয়া এবং এটি অন্যতম গুরুতর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ২০০৮ সালের সিচুয়ান ভূমিকম্পে ৮৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অঞ্চলটি তিব্বত উপত্যকার পূর্ব বলয়ে অবস্থিত। সে সময় ওই ভূমিকম্পের জন্য সেখানকার বড় বাঁধ ও জলাধারকে দায়ী করা হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ ও জলাশয় তৈরি হলে, সেটা যে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়াবে না– তা কে বলতে পারে! কী হবে কোনো ভূমিকম্পে বাঁধটা ধসে গেলে?
অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীপ্রবাহে পরিবর্তন আনতে পারে– এমন কোনো কাঠামো তৈরির আগে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার নিয়ম চীন মানেনি। ভারত ও চীনের মধ্যে কোনো ন্যায্য পানি বণ্টন চুক্তি না হলে তা দুই এশীয় পরাশক্তির মধ্যে নতুন সংঘাতের জ্বালানি জোগাবে। সেই চুক্তিতে বাংলাদেশের হিস্যা নিশ্চিত না হলে ফারাক্কা ও তিস্তার মতো বড় রকমের পানিবঞ্চনার শিকার হবে বাংলাদেশ। অন্যভাবে বলা যায়, পদ্মা ও তিস্তার ন্যায্য হিস্যাবঞ্চিত হওয়ায় এমনিতেই নাজুক বাংলাদেশের নদীব্যবস্থা ব্রহ্মপুত্রে মার খেয়ে মুমূর্ষু হয়ে পড়বে। আরও শুকিয়ে আসবে ১৮ কোটি মানুষের এই দেশের জীবননালি। চীন মেকং নদীতে যে ১১টি বড় জলকাঠামো তৈরি করেছে, সেসব নিয়ে ভাটিতে থাকা মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের ভোগান্তি থেকে তাই শেখার আছে। এসব দেশকে চাপে রাখতে চীন মেকং নদীর পানিকে অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে। শান্তি ও যুদ্ধে নদীর প্রবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিতে পারে আরেক বাস্তবতা। চীনের জবাবে ভারতও অরুণাচলে ১০ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুতের বাঁধ ও জলাধার তৈরির কথা বলছে। এ প্রকল্পে পানি সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখার কথা বলেছেন এক ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু ভারত ইতোমধ্যে চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করায় নতুন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তব প্রয়োজন নেই। তবে অরুণাচল প্রদেশ ঘিরে ভারত ও চীন যে ধরনের বিবাদে লিপ্ত, তাতে জ্বালানির জন্য অদরকারি হলেও ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনে তারা বাঁধের জবাবে বাঁধ বানাতেও পারে। সেই ভারতীয় বাঁধ যত নিচের দিকে হবে, বাংলাদেশের দিকে পানিপ্রবাহ তত কমবে। এর মানে হলো, তিব্বতে চীনের পানি আটকে রাখায় যত সমস্যা হবে, অরুণাচলে বাঁধ হলে তা আরও বাড়বে; যেহেতু অরুণাচল থেকেই ব্রহ্মপুত্র বেশি পানি পায়। ভারত ও বাংলাদেশ এখানে একযোগে চীনের সঙ্গে আলোচনায় নামতে পারে। এই ত্রিপক্ষীয় দর-কষাকষি ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন বিষয়েও ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা যে বাংলাদেশের ঠিকানা, সেই ঠিকানা তৈরিতে ব্রহ্মপুত্রের অবদান এখনও বিপুল; এখনও এই নদের পানি সুন্দর; এখনও এই নদের পলিতে উর্বর হয় বাংলাদেশ; এখনও বঙ্গোপসাগরে এই নদ বাড়াচ্ছে ভূমি– ভুল কিছু করার আগে এটা যেন আমরা মনে রাখি।