আমার স্বামী রবিচন্দ্রন অশ্বিন ১০০তম টেস্ট খেলার দুয়ারে দাঁড়িয়ে। আর আমাদের বিয়ের বয়স হলো ৯৮ টেস্ট। তার অভিষেকের পরপরই আমাদের বিয়ে হয়। সে ধর্মশালায় রওনা দেওয়ার আগে যখন আমরা কথা বলছিলাম, তার মাত্র কয়েকটি উইকেট নেওয়ার স্মৃতি মনে করতে পেরেছি। পাঁচ বছর আগেও আমি এসবের হিসাব রাখতাম, কিন্তু তারপর আগ্রহটা কমে আসে। এসবে আচ্ছন্ন হতে চাইনি। দ্রুতই ৯৯ টেস্ট চলে গেল।
লোকে বাইরে থেকে যা ভাবে, একজন পেশাদার ক্রিকেটারের জীবন তা থেকে একদমই আলাদা। বিয়ের আগে আমরা ডেটিংয়ে যাইনি। সে–ও আমাকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করেনি। বিয়ের পরই আমাদের কলকাতায় যেতে হয়েছিল। কারণ, পরদিন টেস্ট ম্যাচ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। আর (বিয়েতে) সংবাদমাধ্যমের এতটা মনোযোগ থাকবে, তা বুঝিনি। মনে আছে, সে আমাকে মঙ্গলসূত্র পরিয়ে দেওয়ার সময় চারপাশে আলোকচিত্রীরা গিজগিজ করছিলেন। সেই ভিড়ে আমরা নিজেদের জন্য ঠিক করা আলোকচিত্রীকেই খুঁজে পাইনি। একজন ক্রিকেটারের পাশে থাকলে কী হয়, সেবারই প্রথম টের পাই।
কিন্তু আমি এই মনোযোগ চাইনি। নিজের স্বতন্ত্রবোধ নিয়ে সচেতন ছিলাম। আশপাশে কী হচ্ছে, সেসবের জালে ফাঁসতে চাইনি। খেলার সরঞ্জাম কীভাবে গুছিয়ে ব্যাগে তুলতে হবে, সেটাও বুঝতাম না। নেট সেশন কী সেটা বুঝতাম, কিন্তু এটা জানতাম না, অনুশীলনের পর আলাদা করে জিম সেশনও করতে হয়! সে তিন সংস্করণেই খেলায় এবং এক শহর থেকে আরেক শহর করায় আমি কোথাও থিতু হতে পারিনি। ব্যাপারটা গ্লামারাস ছিল না। হ্যাঁ, ভালো হোটেলে থাকতাম। কিন্তু ওই পর্যন্তই। হোটেলের ভেতর মানুষটির সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ খুব কমই মিলেছে। আর ঘরের মাঠে খেলা হলে তো কথাই নেই, মোটেও বাইরে পা রাখা যাবে না। ঠাসা সূচি এবং অন্যান্য কারণে খুব অসুবিধা হতো।
খেলাটিকে কতটা ভালোবাসার জন্য এসব অসুবিধা আমি উতরে যেতে পেরেছি জানি না। আমি জানি, আমি তাকে ভালোবাসি। তবে তার কাজকে ভালো না বাসলে আজ আমি যা করছি, সেটা কি করতাম? তাকে অগ্রাধিকার দিতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে প্রথম কয়েক বছর খুব অস্থিরতায় ভুগেছি, সেটা বিয়ের জন্য নয়; বরং তাকে নিয়ে আমি যা যা গড়তে পারতাম, সেসবের বেশির ভাগই কেড়ে নিচ্ছিল এই পেশা (ক্রিকেট খেলা)। সন্তান হওয়ার পর আর সময় চাইনি। আমার বুঝতে সময় লেগেছে যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সফল হতে হলে কিছু না কিছু ত্যাগ করতেই হয়। সেটা হতে পারে মা–বাবাকে সময় দেওয়া কিংবা স্ত্রী–সন্তানকে।
কোভিডের সময় আমরা আরও কাছাকাছি আসি। সেটা ছিল সমস্যারূপে আশীর্বাদ। কারণ, হঠাৎই মনে হয়েছিল, সে হয়তো আর ক্রিকেট খেলবে না। বিয়ের আট–নয় বছর পর তখন সাধারণ স্বামী–স্ত্রীর মতো এক ছাদের নিচে বসবাস করেছি। কোভিডের সময়ই অশ্বিন বুঝতে পারে, পরিবারও তার জীবনের অংশ।
২০১৭ সালে তাঁর ক্যারিয়ারের বড় বাঁকবদল হয়। বছরটির মার্চ মাসে সে আমাকে বলেছিল, ‘আমি লেগ স্পিন নিয়ে কাজ করছি। এটা করতে না পারলে ছিটকে পড়ব।’ তখন কথাটাকে তেমন পাত্তা দিইনি। কারণ, কিছুদিন আগেই সে আইসিসির বর্ষসেরা খেলোয়াড় ও বর্ষসেরা বোলার হয়েছে। ২০১৬–১৭ মৌসুমে ঘরেও সে দারুণ করেছিল। কিন্তু সে বছরের মাঝামাঝিতে সে সাদা বলের সংস্করণে দল থেকে বাদ পড়ে। তখন সময়টা খুব কঠিন ছিল।
সে ঠিক জানত না, তাঁকে বাদ না বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে। তখন তাঁকে ভুগতে দেখেছি। আর আমিও ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। দুই সন্তান সামলাতে হতো। তাই নিজের কষ্টটা সে আমাদেরও বলতে পারেনি। ওটাই সম্ভবত একমাত্র সময় যখন সে আমাদের কিছু বলতে পারেনি। বাইরের সাহায্য নিতে হয়েছে। কাউন্সেলিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ব্যাপারটা মেনে নিতে তাঁর প্রায় এক বছর লেগেছে। কিন্তু তারপর সে একদমই অন্য মানুষ হয়ে গেল। একবারের জন্যও দলে ফেরা নিয়ে ভাবেনি, শীর্ষে উঠতে চেয়েছে।
মাঠে সে নিখুঁত হলেও মাঠের বাইরে কিন্তু তা নয়। বাসায় আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। সে এলে মনে হতো আমাদের দুনিয়ায় কেউ এসেছে। তার জন্যও ব্যাপারটি তেমনই। সব সময় তাকে বলি, তুমি অবসর নেওয়ার পর জীবন কীভাবে কাটাব, তা নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। বাবা হিসেবে সে কর্তব্যপরায়ণ। স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে দৌড়াতে ভালোবাসে। বাচ্চাদের সে ব্যাট করতে শেখায়। আইপিএল শেষে হয়তো বোলিং করতেও শেখাবে। তামিল সিনেমারও পাগল। বাচ্চাদের মাথায় তামিল সিনেমার পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই সে বাসায় এলে বাচ্চারা টিভি দেখার জন্য একটু বেশিই সময় পায়।
তার ১০০তম টেস্ট নিয়ে যতটা আনন্দ হচ্ছে, ৪৯৯ উইকেটের সময় তেমনটা হয়নি। কারণ, অশ্বিন এ নিয়ে কিছুই বলেনি। রাজকোটে (টেস্টে) বাচ্চারা স্কুল থেকে আসার প্রায় মিনিট পাঁচেক পরই সে ৫০০তম উইকেটটি পায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচুর ফোন আসা শুরু হয়, সবই শুভেচ্ছাবার্তা। ওই সময় মায়ের (অশ্বিনের মা) চিৎকার শুনতে পাই, তিনি পড়ে গিয়েছিলেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে নিয়ে আমরা হাসপাতালে পৌঁছাই। তখন সিদ্ধান্ত নিই, অশ্বিনকে খবরটি জানাব না। কারণ, রাজকোট থেকে চেন্নাইয়ের ফ্লাইটের ব্যবস্থা তেমন ভালো না।
তাই আমি চেতেশ্বর পুজারা ও তার পরিবারকে ফোনে ঘটনাটি জানাই এবং তারা ভীষণ সাহায্য করেছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পর অশ্বিনকে জানাই। কারণ (মায়ের) স্ক্যান করার পর চিকিৎসক বলেছিলেন, এমন পরিস্থিতিতে ছেলের পাশে থাকাটা সমীচীন। ফোনে তার কণ্ঠ শুনে মনে হয়েছিল, সে ভেঙে পড়েছে। ধাতস্থ হতেই তাঁর ২০–২৫ মিনিট লেগেছে এবং তারপর সে আবারও ফোন করে। রোহিত শর্মা, রাহুল ভাই (দ্রাবিড়) এবং বাকিদেরও ধন্যবাদ। এর পাশাপাশি বিসিসিআইকেও—সে বাসায় আসা পর্যন্ত তারা খোঁজ রেখেছেন, অনেক রাতে সে বাসায় এসেছে।
মাকে আইসিইউতে দেখাটা তার জন্য খুব আবেগময় মুহূর্ত ছিল। মা একটু সুস্থ হয়ে ওঠার পর আমরা তাকে দলে ফিরতে বলি। তার ব্যক্তিত্ব বিচারে বলতে পারি, ওভাবে ম্যাচ ছেড়ে আসার মতো মানুষ সে নয়। ওই কদিনে বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা–মায়ের সঙ্গে তার কী গভীর সম্পর্ক এবং বয়স আর পরিণত হওয়ার সঙ্গে এটা আরও বেড়েছে।
কিছুদিন হলো আমরা জীবন এবং তার অবসর নিয়ে কথা বলছি। আমার মনে হয় অবসর–পরবর্তী জীবনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা আপনি পছন্দ করুন বা না করুন—ক্রিকেট ছাড়ার পর আপনি জীবন কোন পথে নেবেন, সেটা ঠিক করে দেবে। আমরা চার–পাঁচ বছর আগে থেকেই এ নিয়ে কথা বলছি। বলেছি, তোমার এমন কিছু শখ থাকা উচিত যার সঙ্গে ক্রিকেটের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, তোমার এর বাইরে এমন কিছু থাকতে হবে, যা তুমি ভালোবাসো। কয়েক বছর ধরেই আমরা এটা বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু সে এখনো কিছু খুঁজে পায়নি (হাসি)।
যে মাইলফলকের সামনে সে দাঁড়িয়ে, সেটা আসলে তার নিয়মানুবর্নিতা এবং অবিশ্বাস্য কমিটমেন্টেরই সাক্ষী। আমি শতভাগ নিশ্চিত, এটা সে বাবা–মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে এবং দেখে খুব অবাক লাগে যখন সে অন্যান্য কাজেও এসব গুণের সন্নিবেশ ঘটায়। সেটা হোক নিজের ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে কিছু কিংবা অনলাইনে দাবা খেলা। এই লেখা যখন লিখছি, তখন আমরা ধর্মশালায় রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কী যে আনন্দ লাগছে! অভিনন্দন অশ্বিন। আমরা একসঙ্গে ৯৯ টেস্ট পর্যন্ত এলাম। তুমি যেসব ম্যাচ খেলেছ, যেসব খেলনি—আমরা সবকিছু নিয়েই গর্বিত। এই অভিযাত্রা মনোমুগ্ধকর ছিল। আশা করি, বাকি পথেও তুমি আনন্দ পাবে।
প্রীতি নারায়ণ (রবিচন্দ্রন অশ্বিনের স্ত্রী)।