বেশির ভাগ দেশ বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে। কিন্তু কার্যকর উদ্যোগের অভাবে তা কমাতে পারছে না বাংলাদেশ।
খেলাপি ঋণে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানটি এখন শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের দখলে। এই দুই দেশ বাদে সবাই খেলাপি ঋণ ক্রমান্বয়ে কমাচ্ছে। ইউক্রেন, ইরাক বা লেবাননের মতো সংকটে থাকা দেশগুলোরই খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। বাকি দেশগুলো মূলত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন, নজরদারি বৃদ্ধি, শাস্তি প্রদান, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না দেওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ আদায় এবং দুর্বল ব্যাংক বন্ধ বা অন্যের সঙ্গে একীভূত করেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনেছে।
খেলাপি ঋণ কমাতে সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির মাধ্যমে। দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশ সরকারি পর্যায়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায় করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এখন বাংলাদেশকে এ ধরনের কোম্পানি গঠনের পরামর্শ দিয়েছে।
সব সুবিধা খেলাপিদের জন্যই
তবে বাংলাদেশ এখন ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও ইচ্ছাকৃত খেলাপি বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশের আইনে নেই। নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ না করলে সবাই ঋণখেলাপি। তবে কী কারণে ঋণ পরিশোধ করা যায়নি, তা নির্ধারণ করেন আদালত।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, উন্নত দেশগুলোতে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত আইনকানুন অত্যন্ত কঠোর। খেলাপি হলে আদালতে যেতে হয়, সেখানে মামলা ঝুলেও থাকে না। আদালতের রায়ে একবার খেলাপি সাব্যস্ত হলে স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে। নানা ধরনের বিধিনিষেধ আসে। কোম্পানি বা ব্যক্তির ঋণমান তখন এতটাই খারাপ হয় যে দ্বিতীয়বার ঋণ পাওয়ার যোগ্য থাকে না। নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে হয়।
কোন দেশে কী আইন
সিঙ্গাপুরে ঋণ খেলাপের শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর জেল ও ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা। অস্ট্রেলিয়ায় ঋণ খেলাপির ক্ষেত্রে করপোরেশন অ্যাক্ট ২০০১ ও ব্যাংক্রাপ্টসি অ্যাক্ট ১৯৬৬ নামে দুটি আইন কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইনের নাম ব্যাংক্রাপ্টসি অ্যাবিউজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কনজ্যুমার প্রোটেকশন অ্যাক্ট এবং দ্য ফ্রড এনফোর্সমেন্ট অ্যাক্ট।
যুক্তরাজ্য ও কানাডায়ও একই ধরনের আইন রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঋণ খেলাপির ব্যাংক হিসাবসহ সমস্ত সম্পদ জব্দ করা হয়। জব্দ করার পর ঋণ পরিশোধ করতে না পারার যথাযথ কারণ দেখাতে পারলে তবেই আদালতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
তবে ঋণখেলাপিদের প্রতি সবচেয়ে কঠোর চীন ও ভিয়েতনাম। এই দুই দেশ ঋণ খেলাপ ও অর্থ আত্মসাতের জন্য মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিয়েছে। চীনের ঋণখেলাপিরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না, বিমান বা রেলের টিকিটও কিনতে পারেন না।
অন্যরা যেভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে
এশিয়ার, বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোই খেলাপি ঋণ কমাতে বেশি সফল। তারা ১৯৯৮-এর অর্থনৈতিক সংকটের পরেই বড় ধরনের সংস্কার করে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে, চরম নাজুক অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকেও উদ্ধার করেছে।
পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সময় দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাংক খাত দেউলিয়া পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারে দেশটি পুরো আর্থিক খাতের খোলনলচেই পাল্টে দিয়েছে। তখনই দুর্বল ব্যাংক বন্ধ করে দেয়, কিছু ব্যাংককে বড় ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হয়। গঠন করা হয় দ্য কোরিয়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন (কেএএমসিও) নামের একটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি। এরাই ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বটি নেয়। কোম্পানি খেলাপি ঋণ অন্য উদ্যোক্তার কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করে। এই খেলাপি ঋণ পরে শেয়ারে রূপান্তর করা হয়।
এতে কোম্পানির মালিকানাতেও পরিবর্তন ঘটে। দেশটির আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান কোরিয়া ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংককে মূলধন দেওয়া। এ সময় ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামোও শক্তিশালী করা হয়, রাখা হয় কঠোর নজরদারির মধ্যে। কোরিয়া ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনের কাজই ছিল আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষা করা।
মালয়েশিয়া অবশ্য কোনো দুর্বল ব্যাংক বন্ধ করেনি; বরং মূলধন জোগান, পরিচালনা ব্যবস্থার উন্নতি, কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করে। দেশটি তিনটি নতুন উদ্যোগ নিয়েছিল। যেমন দানামোডাল নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এর কাজ ছিল দুর্বল ব্যাংক খাতকে নতুন করে মূলধন দিয়ে তার কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও পুনর্গঠন করা।
ঋণ বা দেনা পুনর্গঠনের জন্য গঠন করা হয় দ্য করপোরেট ডেট রিস্ট্রাকচারিং কমিটি। আর প্রতিষ্ঠা করা হয় দানাহারতা নামে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। এরা খেলাপি ঋণ কেনাবেচা ও আদায়ের কাজটি করে। খেলাপি ঋণ কীভাবে কেনাবেচা করা হবে তার একটি নীতিমালাও সরকার করে দেয়। ২০০৫ সালে সরকার দানাহারতা বন্ধ করে দিলেও এখন বেসরকারি খাতের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ঋণ আদায়কারী কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে।
ব্যাংক নিয়ে আস্থার সংকট কেন
একইভাবে ইন্দোনেশিয়া গঠন করেছিল ব্যাংক পুনর্গঠন এজেন্সি (আইবিআরএ)। আর চীন তাদের চারটি বৃহৎ ব্যাংকের জন্য পৃথক চারটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে। থাইল্যান্ডও সরকারিভাবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে। তবে ফিলিপাইন কাজটি করেছে বেসরকারি খাতের সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির মাধ্যমে।
বাংলাদেশ নিয়ে এডিবি যা বলছে
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বিষয়ে কোনো সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি নেই। বেসরকারি খাতে কিছু ঋণ আদায়কারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা খুব একটা কার্যকর নয়। আর খেলাপি ঋণ কেনাবেচার ব্যবস্থা চালু থাকলেও তার নেতিবাচক প্রভাবই বেশি। কেননা, মূলত এখানে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক অন্য বেসরকারি ব্যাংকের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ কিনে নিয়েছে। আর এ সুবিধা পেয়েছে প্রভাবশালীরাই। তারা এর ফলে নতুন করে ঋণ নিয়ে আবারও খেলাপি হয়েছে।
তুলনামূলকভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খেলাপি ঋণ কেনাবেচার বাজার রয়েছে। এশিয়ার কিছু দেশেও এ রকম আইনি ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অন্য ব্যাংকের কিনে নেওয়ার নজির খুব একটা নেই।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল করোনার ঠিক আগে। পরে পুরো এশিয়ার খেলাপি ঋণ নিয়ে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে তারা। এডিবি কোরিয়া বা মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশেও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করতে পারে বলে সুপারিশ করেছে।
এডিবি বলেছে, এই কোম্পানি খেলাপি ঋণ কিনে নীতিমালা অনুযায়ী অন্য কোনো কোম্পানির কাছে বাস্তবসম্মত দরে বিক্রি করতে পারে। সরকারি ব্যাংককেও ভালো কোম্পানির কাছে খেলাপি ঋণ বিক্রি করার অনুমোদন সরকার দিতে পারে। তবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনই যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় আইন ও এর প্রয়োগ করতে হবে। আর থাকতে হবে রাজনৈতিক ইচ্ছা।
বাংলাদেশ কী করছে
দেশে ব্যাংক খাত ও খেলাপি ঋণ নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছিল ১৯৮৬ সালে, অর্থ ও ঋণ নিয়ে একটি জাতীয় কমিশন গঠনের মাধ্যমে। এরপর দাতাদের সহায়তায় আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ, সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়।
অর্থঋণ আদালত আইন পাস করা হয় ১৯৯০ সালে, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ সালে আর ১৯৯৭ সালে পাস হয় দেউলিয়া আইন। এত কিছুর পরও খেলাপি ঋণ তেমন কমেনি; বরং উল্টো ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে ২০০৯ সালে যে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আর আইএমএফের সংজ্ঞা মানলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি, প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা।
প্রভাবশালীদের বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে মূলত ২০০৯ সালের পর থেকে। তাদের চাপে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়, ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেওয়া হয় খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা, ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়, আর সর্বশেষ ২০১৯ সালে ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। এসব ছাড়ের কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে, ঘটেছেও অনেকগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারি।
ইচ্ছাকৃত বনাম অনিচ্ছাকৃত খেলাপি
ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিষয়টি আসলে ভারত থেকে আমদানি করা। কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নীতি রোধের উদ্দেশ্যে ভারতে সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স মিশন গঠন করা হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। তারাই ১৯৯৮ সালে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে (আরবিআই) নির্দেশনা দেয়।
পরের বছর আরবিআই একটি নীতিমালা জারি করলেও তা খুব একটা কাজে দেয়নি। পরে এ নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। সেই কমিটির সুপারিশ মেনে ২০০১ সালে নতুন করে নীতিমালা তৈরি করা হয়। পাকিস্তান মূলত ভারতকে অনুসরণ করেই ইচ্ছাকৃত খেলাপি বিষয়টি আইনে অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশ সেই সংজ্ঞাই হুবহু অনুকরণ করেছে।
সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাবেন না, কোনো সংগঠনের পদে থাকতে পারবেন না, নিষেধাজ্ঞা থাকবে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি-বাড়ি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স এবং কোম্পানি নিবন্ধনে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের জন্যই। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মনে করেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে বলেন, যারা খেলাপি হচ্ছে, তাদের কোনো শাস্তি এই দেশে হচ্ছে না। যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি, সেই ব্যাংকও কোনো শাস্তির আওতায় আসছে না। আবার ঋণ পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল, স্থগিতাদেশের নামে অনেক ঋণের প্রকৃত তথ্য গোপন করা হচ্ছে। ফলে দেশে খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা অজানা রয়ে যাচ্ছে না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে হলে আগে প্রকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করতে হবে। এরপর আইনি ব্যবস্থা জোরদার করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুদিন পরপর খেলাপিদের ছাড় দিতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা বন্ধ করে দিতে হবে।