অনেকেই বলেছিল ক্যারিয়ার হবে না, সেই কুদসিয়াই এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা বিভাগের প্রধান

0
167
কুদসিয়া হুদা

কঙ্গো থেকে ইন্দোনেশিয়া, ইরান থেকে ইয়েমেন, ভারত থেকে জর্ডান—যেখানে মানবিক বিপর্যয়, সেখানেই ছুটে যান কুদসিয়া হুদা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স বিভাগের তিনি প্রধান। তাঁর ছুটে চলা জীবনের গল্প শুনেছেন তানজিনা হোসেন

সিরিয়া সীমান্তে কুদসিয়া হুদাছবি: সংগৃহীত

২০০৪ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ইরানের কেরমান প্রদেশের অনেক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। মারা যান ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ। আশ্রয়শিবিরে আশ্রয় নেন গৃহহারা হাজারো মানুষ। দুর্গত এলাকায় ছুটে যান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ কুদসিয়া হুদা। একদিন এক আশ্রয়শিবিরে ছোট্ট এক মেয়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ। চার বছরের ফুটফুটে মেয়েটির সঙ্গে ওর বাবা ও ভাইও আছেন। আলাপের একপর্যায়ে কুদসিয়ার কাছে মেয়েটার আবদার, ‘তুমি কি আমার মাকে এনে দিতে পারবে?’

‘কোথায় তোমার মা?’ জানতে চান কুদসিয়া।

জবাবে মেয়েটি আর তার বাবা যা বললেন, শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান কুদসিয়া। শেষ রাতে যখন ভূমিকম্পে সবকিছু কেঁপে ওঠে, মেয়েকে কোলে করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন মা। আর তার বাবা হাত ধরে টেনে এনেছিলেন ছেলেকে। খানিকটা পথ আসার পর ছোট মেয়েটা কাঁদতে শুরু করে। কারণ, তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী খেলনা পুতুলটা ঘরে ফেলে এসেছে। মুহূর্ত না ভেবেই মেয়েকে বাবার কোলে দিয়ে মা বলেছিলেন, ‘তোমরা যাও, আমি এক্ষুনি পুতুলটা নিয়ে আসছি। যাব আর আসব।’

সেই যে গেলেন, আর ফিরে এলেন না মা!

কুদসিয়ার হৃদয়-আয়নায় নিজের মেয়ের ছবিটা ভেসে ওঠে। দূর দেশে এই মেয়ের বয়সী সন্তানকে রেখে এসেছেন তিনি। বুকটা হু হু করে ওঠে। এক মায়ের সন্তানবৎসল হৃদয়কে উপলব্ধি করে চোখে পানি আসে। চোখের পানি মুছে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে কুদসিয়া বললেন, ‘নিশ্চয়ই একদিন মায়ের সঙ্গে তোমার দেখা হবে। সেদিন তুমি মাকে জানিও যে তুমি তাকে কত মিস করেছ। আর এ জন্য নিজেকে দায়ী কোরো না।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন বাংলাদেশের কুদসিয়া হুদা (সামনে বসা)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন বাংলাদেশের কুদসিয়া হুদা (সামনে বসা),ছবি: সংগৃহীত

ভূমিকম্পের ওই বছরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যোগ দেন কুদসিয়া। এরপর মা-হারা সেই মেয়েটার মতো দেশে দেশে আরও অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়েছে। সেই যে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে সুনামিতে সবাইকে হারানো নারী, কুদসিয়ার মাথায় হাত দিয়ে যিনি আশীর্বাদ করেছিলেন। আফগানিস্তানে যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করা এক চিকিৎসকের অসহায় মুখ, দায়িত্ব পালনের সময় জানতে পারেন বোমার আঘাতে উড়ে গেছে তাঁর পুরো পরিবার। আর সুনামিতে আক্রান্ত এলাকায় সব হারানো সেই তরুণ, আশ্রয়শিবিরে গান গেয়ে যিনি শিশুদের আনন্দ দিতেন। বর্তমানে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তরে ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স (দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন) বিভাগের প্রধান কুদসিয়ার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা আছে এমন অনেক মানুষের মুখ, হৃদয়স্পর্শী সত্য গল্প। কোনো কোনো গল্প তাঁকে যেমন ঘুমাতে দেয় না, তেমনি কোনো গল্প এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাও দেয়। সেদিন আলাপের সময় তেমনি কিছু আশ্চর্য গল্পের ঝাঁপিই খুলেছিলেন কুদসিয়া হুদা।

নিজেও পড়েছেন বিপদে

মিসরে কর্মরত অবস্থায় ২০১১ সালে একবার স্বামী-সন্তানকে কায়রোতে রেখে অফিসের কাজে ওমান গেছেন কুদসিয়া। মাসকাটে বসেই শোনেন আরব বসন্ত শুরু হয়ে গেছে। উত্তাল কায়রো আর ততোধিক উত্তাল তাঁর অতি পরিচিত তাহরির স্কয়ার। একসময় স্বামী-সন্তানের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদিকে মাসকাট থেকেও কিছুতেই আর কায়রোতে ফিরতে পারছিলেন না। তারপর কী কষ্ট আর কত ঝামেলা করেই না অগ্নিগর্ভ কায়রোতে পৌঁছালেন। কারফিউয়ের মধ্যে পথে পথে কূটনৈতিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে স্বামী-সন্তানের কাছে গেলেন। তারপর পুরো পরিবার গৃহবন্দী। সে এক অদ্ভুত সময়। চারদিকে সামরিক ট্যাংক বহর ঘুরছে, থরথর করে কাঁপছে পুরো বাড়ি। বন্দী অবস্থায় আরও কিছুদিন থাকার পর বিশেষ বিমানে জাতিসংঘের অন্য কর্মীদের সঙ্গে মিসর ছাড়তে সক্ষম হন।

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বহুবার এমন ঝুঁকির মুখে পড়েছেন কুদসিয়া। আফগানিস্তানে কাজ করার সময় প্রাচীরঘেরা সুরক্ষিত হোটেলে থাকার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ভূমিকম্পে সব ভেঙে যেতে থাকল। সুরক্ষিত জায়গাটাই তাঁদের জন্য হয়ে উঠল মরণফাঁদ। ঠিক একইভাবে ইরাকে কাজ করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী ভবনে আকস্মিক বোমা হামলা থেকে স্রেফ কপালগুণে বেঁচে গিয়েছিলেন।

কুদসিয়া হুদা
কুদসিয়া হুদা, ছবি: সংগৃহীত

আরাম দেয় লেখালেখি

দুর্গত মানুষেরা যেমন মানসিক কষ্টে ভোগেন, তেমনই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতরাও নানা রকম ট্রমার শিকার হন। বিপর্যস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাজ করতে গিয়ে অনেকে অস্বাভাবিক হয়ে পড়েন।

কুদসিয়া হুদা বলেন, ‘আমাদের এ জন্য নানা রকম প্রশিক্ষণ নিতে হয়। তারপরও মাঝেমধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে।’

এ জন্য এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কুদসিয়া হুদা শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম করেন, নিয়ম করে ধ্যানও করেন। মন ভালো না হলে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আমার বরের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করেও আমি অনেক স্বস্তিবোধ করি। তবে সবচেয়ে যে জিনিসটা আমাকে প্রশান্তি এনে দেয় তা হলো, লেখালেখি। আমার স্ট্রেস দূর হয় এতে।’

কুদসিয়া হুদার লেখক নাম দীপা ফিরোজ। তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। ছোটবেলায় শেখা গানের চর্চাও ধরে রেখেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গান।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিপজ্জনক আর চ্যালেঞ্জিং পেশায় কাজ করতে গিয়েও প্রিয় পোশাক শাড়ির প্রতি ভালোবাসা হারাননি। জেনেভায় নিজের অফিসে প্রতিদিন শাড়ি পরেন। যেকোনো দেশে বিপর্যয়ের খবর পেয়ে উড়াল দেওয়ার সময় স্যুটকেসে অন্তত একটা শাড়ি নিতে ভোলেন না কখনো। ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরাম কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সম্মেলন, জলবায়ু সম্মেলনে পুরোপুরি বাঙালি বেশভূষায় হাজির হন কুদসিয়া।

পৃথিবীর নানা ভাষা আর সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে কাজ করতে সমস্যা হয় না। তিনি বলেন, ‘যে দেশ বা যে কমিউনিটিতে কাজ করি, তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার জন্য দরকার তাদের জীবনযাত্রার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। যেমন ইরানে কাজ করার সময় লম্বা পোশাক পরতে হতো, আমার দীর্ঘ চুল তখন পিন দিয়ে আটকে স্কার্ফে মাথা ঢাকতে হতো। এত সব কাজের মধ্যেও আমাকে মাথার স্কার্ফ সামলে চলতে হতো। ইয়েমেন, সিরিয়া, সোমালিয়া, ইরাকে কাজের সময় পরতে হতো বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর হেলমেট। আফ্রিকায় ইবোলা সংক্রমণে কাজ করার সময় পরতে হতো জীবাণুরোধী পোশাক। কাজ চালানোর মতো ফরাসি, আরবি ও ফারসি ভাষা শিখেছি। একজীবনে বিচিত্র ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মের মানুষের আপনজন হয়ে ওঠা—এ এক পরম পাওয়া।’

অনেকেই বলেছিলেন, কুদসিয়ার ক্যারিয়ার হবে না

কুদসিয়া হুদার বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা ঢাকায়। ছোটবেলায় গান শিখেছেন, নেচেছেন, ছবি এঁকেছেন, স্কুলে পড়ার সময় ফুটবলও খেলেছেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে এসএসসি আর হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি। এরপর ভর্তি হয়েছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। মেডিকেলে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। প্রথম সন্তানের জন্ম চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময়। বিয়ের পর অনেকে বলেছিলেন, কুদসিয়াকে দিয়ে পড়াশোনা হবে না। সন্তান হওয়ার পর তাঁরাই বলতে থাকলেন, তাঁকে দিয়ে আর ক্যারিয়ার হবে না।

সবার কথাই ভুল প্রমাণ করেছেন কুদসিয়া। ১৯৯১ সালে এমবিবিএস পাস করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে যোগ দেন। কাজ করতে করতেই স্বাস্থ্য ক্যাডারে বিসিএস দিয়ে পঞ্চগড়ে যোগ দেন। সেখানে প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে কাজ করেছেন। জনস্বাস্থ্য বিষয়টি তখন প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে। তাই পরে এসে যোগ দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে। পরবর্তীকালে এই বিষয়েই উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যান যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।

হার্ভার্ডে পড়তে পড়তেই একটি মাস্টার্স কোর্সে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পান। সেটি ছিল হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ, টাফট বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একটি সমন্বিত কোর্স। আমন্ত্রণ পেয়েও দ্বিধায় ছিলেন কুদসিয়া। ছোট ছোট দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে হার্ভার্ডে পড়তে গিয়েছিলেন তিনি। যাদের একজন তখনো দুগ্ধপোষ্য শিশু। দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে একা বোস্টনে থাকা, স্কুলে ও ডে কেয়ারে রাখা, আনা-নেওয়া, রান্নাবান্নাসহ সব কাজ করে পড়তে বসতেন গভীর রাতে। কুদসিয়া ভাবলেন আবেদন করে কী হবে, এত কিছু তিনি সামাল দিতে পারবেন না। কিন্তু তাঁর পরামর্শক রিচার্ড ক্যাশ পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘কেন তুমি আবেদন করবে না? মাত্র ২০ জনকে এই সুযোগ দেওয়া হবে। আরেকটা কথা মনে রেখো, তোমার এই সন্তানেরাই তোমার শক্তি। আমার বিশ্বাস, তুমি দুটো মাস্টার্স প্রোগ্রাম করতে পারবে।’

রিচার্ড ক্যাশের কথাটাই এখনো বিশ্বাস করেন কুদসিয়া। আসলে যা যা মানুষ প্রতিবন্ধকতা, বাধা বা দুর্বলতা মনে করে, প্রতিটিই জীবনে শক্তিদায়ী রূপে দেখা দিতে পারে। জনস্বাস্থ্যে পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যোগ দেন ২০০৪ সালে। এরপর সংস্থাটির নানা পদে কাজ করেছেন।

কুদসিয়া বললেন, মা-বাবার পর সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন তাঁর স্থপতি স্বামী আর সন্তানেরা। একজন বিবাহিত নারীর এমন যাত্রায় বরের ভূমিকা অনেক। বোঝাপড়া না হলে সবকিছু সামলানো কঠিন!

কুদসিয়ার দুই মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকে দক্ষিণ ভারতের কোদাইকানাল, মিসরের কায়রো থেকে বিলেত—নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে বড় হয়েছেন। দুজনই এখন প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে এনার্জি সেক্টরে কাজ করেন, আর ছোট মেয়েটি বাবার মতো স্থাপত্য পেশা বেছে নিয়েছেন।

কুদসিয়া হুদার কাছে জানতে চাই, ‘আপনি একজন এশীয়, তার ওপর বাংলাদেশি নারী। এই পরিচয়গুলো বৈশ্বিক সমাজে কি আপনার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কখনো?’ কুদসিয়া হুদা হেসে বলেন, ‘যেসব বিষয় নিয়ে আমি কাজ করি, যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তা একজন বাংলাদেশির চেয়ে ভালো আর কে বুঝতে পারে? বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, লঞ্চডুবি—এসব দেখেশুনে আর মোকাবিলা করেই বড় হই আমরা।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.